প্রতিবছর বাজেট এলে মধ্যবিত্তদের প্রত্যাশা থাকে, বাজেটে তাদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন পূরণ হোক। জাতীয় সংসদে ৬ জুন উত্থাপিত হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। বেশ কয়েকটি কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেট নানাভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। একে তো আগামী অর্থবছরের বাজেট পরিমাণগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহৎ বাজেট। অন্যদিকে বৈশ্বিক আর্থসামাজিক অস্থিরতার নানা দিক বিবেচনায় রেখে উত্থাপন হয়েছে এ বাজেটটি। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফিতি চরম পর্যায়ে। এই সময়ে বড় বাজেট উপস্থাপন সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
বরাবরের মতো আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের রয়েছে নানা রকমের চিন্তা ও টেনশন। এদের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আগামী বাজেট নিয়ে সবচেয়ে উৎকণ্ঠায়। একদিকে মূল্যস্ফিতি ও অফিসের বেতনের সমন্বয়, অন্যদিকে পারিবারিক লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বৃহৎ বাজেট নিয়ে মধ্যবিত্তদের প্রত্যাশা অন্যান্য শ্রেণির তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রম।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েকজনের সঙ্গে বাজেট বিষয়ে জানতে চাইলে আগামী বাজেটে তাদের প্রত্যাশার দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকল নানাভাবে সামাজিক প্রেসারে পরবর্তী সময়ের ধাক্কায় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের খেয়ে-পড়ে টিকে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের বেশিরভাগের মধ্যে যাদের ঘরে কর্মক্ষম ব্যক্তি মাত্র একজন এবং পরিবারের সদস্য তিনের অধিক, তাদের আয়ের সিংহভাগ অর্থ চলে যায় পরিবারের ভরণ-পোষণের পেছনে।
এদের মধ্যে যাদের পরিবারে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা একাধিক তারা অন্নসংস্থান ও বাসস্থানের বাইরেও দেখছেন নানা ধরনের স্বপ্ন। অনেকের স্বপ্ন ভাড়া বাড়ি থেকে একটি ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া, যাদের ফ্ল্যাট আছে তাদের স্বপ্ন নিজস্ব একটি গাড়ি থাকা, অনেকের আবার স্বপ্ন নানা ধরনের আভিজাত্য পণ্যে নিজের স্বপ্নের ফ্ল্যাটকে সাজিয়ে তোলা। নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের বাজেটকে সামাল দিয়ে জাতীয় বাজেটের দিকে তাকিয়ে মধ্যবিত্ত এ শ্রেণি ভাবছেন, অদূরে তাদের স্বপ্নপূরণের কোনো সম্ভাবনা আদৌ আছে কিনা।
বাজেট মধ্যবিত্তদের কাছে সুপরিচিত একটি শব্দ। মাসের শুরুতেই সংসারের খরচ ও জমার হিসাব মিলাতে একটি পূর্ণাঙ্গ বাজেট থাকে মধ্যবিত্তদের। কিন্তু সেই হিসেব কোনোভাবেই মিলাতে পারে না মধ্যবিত্তরা। বেতনের বেশিরভাগ টাকা খরচ হয় বাড়ি ভাড়া আর খাওয়া-দাওয়ায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুলের ফি, টিউশনির টাকা, বাবা-মায়ের ওষুধের যোগান, ঘরের টুকিটাকি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পেছনে খরচ করে বর্তমানে হাতে সামান্য টাকাও থাকে না। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করার মতো কিছুই রাখা সম্ভব হচ্ছে না মধ্যবিত্তদের। অনেকেই ঋণের বোঝায় জর্জরিত।
জাতীয় বাজেট আসলে শুরুতেই এক ধরনের নির্লিপ্ততা কাজ করে। জাতীয় বাজেটে হয় সুবিধা পায় একেবারে যারা উচ্চবিত্ত তারা, আর না হলে যারা নিম্নবিত্ত তারা কিছুটা সুবিধা পায়। ব্যবসায়ীরা ব্যবসার জন্য শুল্ক ছাড় পায়, নানা বিনিয়োগে সুবিধা পায়। অন্যদিকে নিম্নবিত্তের যারা তারা ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য কেনার সুবিধাভোগীদের আওতাভুক্ত হতে পারে, অনেকে আবার ভাতা পায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে বাজেট আসলে মধ্যবিত্তদের জন্য আলাদা করে কিছু থাকে না। সমাজে যেভাবে প্রতিমুহূর্তে মধ্যবিত্ত একজনকে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, তেমনি বাজেটেও এই দুই শ্রেণির মাঝে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক একটি জায়গা বেছে নিয়ে টিকে থাকতে হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে।
মধ্যবিত্তদের মধ্যে মূলত স্বপ্ন ও ভয় সমানুপাতিকহারে কাজ করে। একদিকে এদের ভয় থাকে এমন কিছু যদি ঘটে যায়, যার জন্য নিম্নবিত্তের কাতারে এসে দাঁড়াতে হয়, অন্যদিকে এদের স্বপ্ন থাকে এমন কিছু যদি ঘটতো, যাতে করে উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রাখা যায়। করোনা সময়ে দেখা গেছে, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি চাকরি হারিয়ে অথৈ জলে পড়েছেন।
উচ্চবিত্ত বাঁচে স্বপ্ন পূরণে, নিম্নবিত্ত দুঃস্বপ্নে আর মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকা স্বপ্ন লালনের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি বাজেটে মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা থাকে বাজার স্বাভাবিক হবে, গরুর মাংসের দাম কমবে, ফ্ল্যাট সস্তায় পাওয়া যাবে, গাড়িতে শুল্ক হার হ্রাস পাবে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার সহনীয় হবে- এসব নিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না ঘটলেও বাজেটের পর বাজেট তাদের প্রত্যাশাই বাঁচিয়ে রাখে আগামী আরেকটি অর্থবছরে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখার কিংবা পুরনো স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষা করার জন্য। বাজেটে মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা থাকে তাদের সন্তানদের কর্মসংস্থান হউক। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবসমাজ যেন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। প্রাইভেট স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয় যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে। মধ্যবিত্তদের চাওয়া পাওয়া তাদের আয় ও ব্যয় যেন সমন্বয়ের মধ্যে চলে। বাজেট নিয়ে মূলত নাগরিকদের মধ্যে বেশি একটি আলোচনা সমালোচনা হয় না। কারণ বাজেট এটি একটি দেশে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ঘোষণা হয়ে থাকে। বাজেটকে গতানুগতিকভাবে বললেও বেশি বলা হবে না।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানাদিক বিবেচনায় একটি দেশের বাজেট তৈরি হয়। তাই বাজেট যায়, বাজেট আসে কিন্তু মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা পূরণে তেমন কোনো পরিবর্তন ও আশার আলো প্রতিষ্ঠিত হয় না।
মাহমুদুল হক আনসারী :কলাম লেখক