গত এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দোর্দন্ড প্রতাপ বিজেপি দলকে এবার থাকতে হবে জোট শরিকদের দয়ার ওপর। কাউকে সঙ্গে না নিয়ে চলা মোদিকে এবার চলতে হবে সমজে চলা নীতি অনুসরণ করে। তাই সবার মনে প্রশ্ন উঠেছে জোট সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে।
নরেন্দ্র মোদি কী আদৌও পারবেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে চলতে? সময় হয়তো তার যথাযথ উত্তর দিয়ে দিবে।
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে মোদিকে যে কেন্দ্রে শরিক নির্ভর হতে হবে এটা প্রায় সুনিশ্চিত। সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ২৭২টি আসন এরমধ্যে বিজেপি এককভাবে জিতেছে ২৪০টি আসন। তাদের নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ জিতেছে ২৯৩টি আসনে। এনডিএ-এর জোট শরিক ১৬ এবং ১২টি আসনে জিতে 'গুরুত্বপূর্ণ' হয়ে উঠেছেন দুই সহযোগী নেতা তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-র প্রধান চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং জেডিইউ সভাপতি নীতীশ কুমার। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দাবিতে তারা বিজেপির ওপর চাপ বাড়িয়েছেন বলে বিভিন্ন উৎস হতে খবর আসছে।
ফলে আগামী দিনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মোদির 'একাধিপত্য' খর্ব হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তবে এত কিছুর পরও মোদি এক দশকের 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া' প্রতিহত করে নেহরুর পরে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় 'ইনিংস' শুরু করতে চলেছেন। দল এবং সহযোগীদের মধ্যে তার উচ্চতার সঙ্গে তুলনীয় কোনোও নেতা নেই। ফলে মোদির 'প্রভাব' অটুট থাকারই সম্ভাবনা বেশি। তিনি দল ভাঙানোতে খুব বেশি অভিজ্ঞ। বিরোধীদের প্রতিহত করার সব টেকনিকই তার জানা আছে ভালো করে।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে পুনরায় ফিরছে আবারো সত্যিকারের গণতন্ত্র বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা। মোদির নৈতিক পরাজয়ে তা এখন আরও অনেক বেশি সুস্পষ্ট। গত দশ বছরে মোদির পায়ের নিচে ছিল শক্ত মাটি। তিনি কাউকে পরোয়া না করলেও চলত। কারণ মোদির সঙ্গে ছিল আম্বানি, টাটা ও আদানির মতো বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা। তার সঙ্গে আরও ছিল আজ্ঞাবহ মিডিয়া ও চাটুকার আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন।
ভারতে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ধনী গরিবের মধ্যে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি, জাতপাতের রাজনীতি ও ধর্মীয় বিভাজন মোদির জনপ্রিয়তা হারাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ছিল বিজেপি যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবার পায় তাহলে সংবিধান পাল্টিয়ে ফেলবে। তাই তারা সুকৌশলে মোদিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে।
বিজেপি সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে ভারতের বড় বড় রাজ্যগুলোতে যেখানে লোকসভার আসন সংখ্যা বেশি ছিল। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ তাদের মধ্যে অন্যতম। বিজেপি সবচেয়ে জয়ী আসন হারিয়েছে উত্তর প্রদেশে। নরেন্দ্র মোদির চকচকে ব্যান্ড ইমেজ, গদি মিডিয়ার জয় স্তুতি মোদিকে যেভাবে অজেয় ও মহান করে তুলেছিল, সে মোদি আসলে ততটা শক্তিশালী নন এটা এখন প্রকাশ্য দিবালোকে মতন প্রমাণিত হয়েছে।
ভারতে কংগ্রেস দল প্রমাণ করেছে এক দশক ক্ষমতায় না থেকেও ফুরিয়ে যায়নি তাদের দম। রাহুল গান্ধীকে পাপ্পু বলে ঠাট্টা মশকারি করা কিংবা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতজুড়ো আন্দোলনকে বিদ্রম্নপ করা বিজেপি ঠিকঠাক বুঝে গেছে কংগ্রেস যে কোনো মুহূর্তে ক্ষমতার দাবিদার। বিজেপি এখন ভয়ে থাকছে যে কোনো মুহূর্তে না তাদের জোট ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়। জোট মিত্রদের দয়ার ওপর দাঁড়িয়ে কতটা কারিশমা দেখাতে পারবেন বিজেপি সেটি এখন দেখার বিষয়। বিজেপির দম্ভ কী একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মাটিতে মিশে যাবে?
তবে এটা ঠিক বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো অনেকটা হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়েছে, কিন্তু বিজেপি তো আর মারা যায়নি কিংবা আইসিইউতে যাইনি, যা হয়েছে তা সব সাময়িক ক্ষতি হয়েছে বিজেপির। তাতে হাসপাতালে নেওয়া হলে কিংবা ডাক্তার দেখালে ভালো করা সম্ভব। বিরোধী তথা ইন্ডিয়া জোটের এত আস্ফালনও ঠিক না যে তারা এখনই মোদিকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসবে। তাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে মোদি ততটা তালপাতার সিপাহী না, তিনি ভালো করে জানেন কীভাবে ক্ষত সারাতে হয়।
বিজেপি দলের মোদিই হলো শেষ কথা। তার হাই কমান্ড সবাই মানতে বাধ্য। যে মোদি এতদিন আত্মনির্ভরের কথা বলেছেন সে মোদিই এখন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। মোদি ভোটে জনমতের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ না পাওয়ায়, সরকার গঠন করাকে নৈতিক পরাজয় দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কোনো সরকারের মূল শক্তি হচ্ছে সংখ্যা, সেই পর্যাপ্ত সংখ্যাই এখন নেই বিজেপির হাতে। তাই দেখার বিষয় কতটা কৌশলে নিজেদের সিংহাসন তারা ধরে রাখতে পারে।
গত এক দশক ধরে মোদির 'নিরঙ্কুশ' ক্ষমতা দেখেছে ভারতের জনগণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাশাপাশিই তার দপ্তরের বিপুল ক্ষমতা এবং প্রভাবও আলোচনায় এসেছে বার বার। কেন্দ্রে প্রথম বার জোট সরকারের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং তার দপ্তর সেই 'কর্তৃত্ব' বজায় রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। জোট রাজনীতিতে মোদির এই অভিজ্ঞতা না থাকাকে দুর্বলতা দেখছেন অনেকে। অবশ্য বিজেপির আগের আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের নেপথ্যেই যে মোদির 'দীর্ঘ ছায়া' রয়েছে, একাধিকবার তা জানিয়েছেন বিজেপির অনেক নেতাই। বিভিন্ন সময়ে মোদি তৎপরতা যেন তার ইঙ্গিত মিলেছে। এমনকি, ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের কার্যত অন্ধকারে রেখেই নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে মোদির বিরুদ্ধে। বিশেষত, প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের এড়ানোর অভিযোগ উঠেছে একাধিক বারেই। এ ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে চলে এসেছে মোদির 'ঘনিষ্ঠ' হিসেবে পরিচিত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের নামও। খাতা-কলমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা থাকলেও এতদিন পর্যন্ত কার্যত মোদি একাই সব দপ্তরের ভার সামলেছেন বলে দলের একটি অংশ জানাচ্ছে। বিপুল কাজের চাপ সামলাতে আক্ষরিক অর্থেই রাতের ঘুম বাদ দিতে হয়েছে কখনো কখনো মোদিকে।
বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার ২৪টি দল নিয়ে জোট সরকার চালিয়েছে, যা ভারতের ইতিহাসে বিরল। জোট সরকার পরিচালনায় অন্যতম সফল উদাহরণের দাবিদার পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতিবসু সরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে এনডিএ জোট দলগুলোর নিঃশর্তভাবে কী নরেন্দ্র মোদিকে সহযোগিতা করবে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। ইতিমধ্যে জোট শরিকরা বিভিন্ন কায়দা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মোদি কী পারবে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়ন করতে? সবার জন্য এক দেওয়ানী বিধি আইন (ইউনিভার্সেল সিভিল কোর্ট), এক দেশ এক ভোট, ৩৭০ ধারা বাতিল এই রকম অসংখ্য নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি কার্যকর করতে। এসব বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তার ওপরে রয়েছে সিএ বিল, এনআরসি, কৃষক আন্দোলন, যা নতুন মোদি সরকারকে আরও চাপে রাখবে। মোদির সমালোচক এখন বিরোধীরা নয় বরং নিজ দলের জোট সঙ্গীরাও। এখন দেখার বিষয় এ চাপ কতটুকু সামলে নিতে পারে নরেন্দ্র মোদি। তবে এটা ঠিক ভারত অনেকদিন পর শক্তিশালী বিরোধীদল পেল, যা বহুদলীয় গণতন্ত্রের শক্তি। আগামী দিনগুলোতে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে তা তার দেওয়া প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে।
প্রশান্ত কুমার শীল :গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক