সুন্দরবনের টেকসই সুরক্ষা দরকার
প্রকাশ | ০৯ জুন ২০২৪, ০০:০০
সুমাইয়া আকতার
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে বিপর্যস্ত বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা ৭-১০ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মিষ্টি পানির পুকুরগুলো সব লবণ পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। লবণ পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে অন্তত ৮০টি মিঠা পানির পুকুর। ভেঙেছে বনবিভাগের অবকাঠামো। বন্যপ্রাণী এখন অস্তিত্ব সংকটে। এতে বন্যপ্রাণীর বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছে বনবিভাগ। বিশেষ করে কটকা, কচিখালি, নীলকমল, মান্দারবারি, হলদিবুনিয়া এলাকায় সব থেকে বেশি পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। এসব এলাকা হরিণ, বানর, শুকরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য।
বনবিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৭ সালে সিডরের পর সুন্দরবনে ৪০টি হরিণ, একটি বাঘ ও একটি তিমির মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০০৯-এ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর তিনটি হরিণ ও একটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৩-২০১৯ সাল পর্যন্ত হওয়া ঝড়গুলোতে বাঘ, হরিণসহ অন্য কোনো বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে চারটি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া যায়। কিন্তু সম্প্রতি আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেমাল সুন্দরবনের এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্ষতির পরিমাণে রেকর্ড ভেঙেছে। বনবিভাগ ও সুন্দরবন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালে এবার 'অস্বাভাবিক' পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সুন্দরবন। স্বাভাবিক সময় ২৪ ঘণ্টায় দুইবার ভাটা এবদুধুইবার জোয়ারে পানিতে পস্নাবিত হয় বনের একটি অংশ। কিন্তু এবারই প্রথম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে থেকে পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টায় বনে কোনো ভাটা হয়নি। অর্থাৎ, এই দীর্ঘ সময় পুরো বন পানিতে তলিয়ে ছিল। আর জোয়ারে পানির উচ্চতা ছিল স্বাভাবিকের চাইতে ৫-৬ ফুট, কিছু এলাকায় এর চেয়েও বেশি।
দীর্ঘ সময় এত উঁচু জোয়ারের ফলে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা করছিলেন বন কর্মকর্তারা। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এ ছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর, বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী।সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রলয়ংকারী আঘাত হানার কারণে মোট ১২৭টি হরিণ ও চারটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বনসংরক্ষক মিহির কুমার দে। তিনি বলেন, এসব বন্যপ্রাণীর মৃতদেহের অধিকাংশই সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা, কচিখালী, দুবলা, নীলকমল, আলোরকোল, ডিমের চর, পক্ষীরচর, জ্ঞানপাড়া, শেলার চরসহ নদী ও খালে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বেশির ভাগ অংশ পস্নাবিত হয়। কোথাও কোথাও স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে ২-৬ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়েছে। উচ্চ জোয়ারের পানি সুন্দরবনের গহিনে চলে যাওয়ায় হরিণগুলো ভেসে গিয়ে সাঁতরে কূলে উঠতে পারেনি। এ কারণে হরিণগুলো মারা যেতে পারে বলে ধারণা বনবিভাগের। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবের দফায় দফায় উচ্চ জোয়ারে সুন্দরবনের সব নদী-খাল উপচে বনের বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়। এই জোয়ারের উচ্চতা ছিল ১০-১২ ফুট।
এ ছাড়া ১৮টি হরিণ ও একটি অজগর অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের বনে ছেড়ে দিয়েছে বনবিভাগ। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান এখন হুমকির মুখে। যেটা প্রাকৃতিক ভারসাম্যতাকে সংকুচিত করে তুলেছে এবং সুন্দরবন এবং সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা অঞ্চলগুলো তীব্র জীববৈচিত্র্যের হুমকির সম্মুখীন হতে চলছে। খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার বলেছেন, একটানা ২০ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বনবিভাগের বিভিন্ন বন অফিসসহ টহলবোট, টিনের চালা, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। ১৮টি জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের তিনটি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার। একটি পল্টুন ভেসে গেছে। এতে দুই কোটি ৬১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
জলোচ্ছ্বাসে কটকা অভয়ারণ্যে অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কোচিখালি, বগিসহ বিভিন্ন বন অফিসের ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অবকাঠামোর টিনের চালা উড়ে গেছে। এ ছাড়াও ১০-১২ ফুট উচ্চতার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণীও সুপেয় পানির অভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। পাশাপাশি সুন্দরবনের অবকাঠামোগুলোও ক্ষতির মুখে পড়েছে। পর্যটকদের চলাচলের কাঠের পুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা তছনছ হয়েছে। তবে পুরো সুন্দরবনের গাছপালাসহ কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা অনিশ্চিত। সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি। যেটি পর্যটকদের অবাধ বিচরণের স্থান হিসেবেও বেশ সমাগম। কিন্তু গত ১ জুন থেকে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ করায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কারণ এই তিন মাস সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ও বণ্যপ্রাণীদের প্রজনন মৌসুম। পাশাপাশি এই তিন মাসের নিষেধাজ্ঞায় সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে জীববৈচিত্র্যের সরল-সৌন্দর্য আগের মতোই ফিরে আসতে পারে। সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, 'বনের গাছে শত শত পাখির বাসা ছিল, ডিম-বাচ্চা ছিল। এখন গাছে কোনো পাখি নেই। হরিণ মারা গেছে, গাছ নষ্ট হয়েছে, টাকা দিয়ে এসব মাপা যায় না। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে।'
এ ছাড়া মিঠা পানির পুকুরগুলো লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর ওপর স্থায়ী প্রভাব পড়বে। কারণ, পুকুরের মিষ্টি পানি বন্যপ্রাণীর তৃষ্ণা মেটাত। তাই জরুরি ভিত্তিতে পুকুরগুলো ডিওয়াটারিং করে সেখানে বর্ষার মিষ্টি পানি ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী ও গাছপালার যে ক্ষতি হয়, তা নিরূপণ করা সময়সাপেক্ষ হলেও টেকসই উন্নয়নকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনামাফিক সুন্দরবনের অবকাঠামোর মান উন্নয়নকে সমুন্নত করতে হবে। পাশাপাশি বেড়িবাঁধ, পোল্ডার ও যোগাযোগ অবকাঠামোর মেরামত করাও বাঞ্ছনীয়।
সুপেয় পানির সংকট নিরসনকল্প ধারাবাহিকভাবে চালু রাখতে হবে। সুন্দরবনের টেকসই সুরক্ষাকরণের নিশ্চিয়তায়ন আগামী ভবিষ্যতের একটি সময়োপযোগী চাহিদার অন্যতম প্রেক্ষাপট। কারণ, এতে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন,সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রাকৃতির প্রাচীরে বিরূপ প্রভাবে ফেলবে।
সুমাইয়া আকতার
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ