আলস্নাহ তা'আলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, আলস্নাহ তা'আলার ক্ষমতা চিরস্থায়ী এবং তিনি মহাপরাক্রমশালী। সুরা আল ইমরানের ২৬নং আয়াতে আলস্নাহ তা'আলা ঘোষণা করেন, 'হে প্রিয় হাবীব (দ.) আপনি বলুন, হে আলস্নাহ! আপনিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। আপনারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাশালী'। হাদিসে কুদসিতে আলস্নাহ তা'আলা আরও বলেন, 'হে আদম সন্তান, কারও ক্ষমতাকে কখনো ভয় কর না! যতক্ষণ না আমার ক্ষমতা (রাজত্ব) থাকবে'। রাজনীতি এবং ক্ষমতা দুটি বহুমুখী শব্দ; কিন্তু পরিধি অনেক বড়। বৈশ্বিক রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা সর্বাধিক। গণতন্ত্র হলো 'জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার' (মড়াবৎহসবহঃ নু :যব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব, ড়ভ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব)- আব্রাহাম লিংকনের এই লাইনটি যদি হয় গণতন্ত্রের সর্বজনীন এবং সর্বাধিক সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা, তবে শোষণ মীমাংসার উদ্যোগ নেয়নি কেন? লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা শুধুমাত্র সরকার গঠন ও চরিত্র গঠনের রূপ মাত্র। জনগণের অধিকার সুনিশ্চিতকরণের ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি লিংকনের এ গণতন্ত্রে। পুরুষশাসিত সরকার ব্যবস্থা ও শোষণনীতির ব্যাপারে সমাধান বা মীমাংসা করলে সংজ্ঞাটি যথার্থ হতো। লিংকনবাদীরা এ গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসিন হয়, তারপর গরিব ও অসহায়দের প্রতি বৈষম্যনীতি বাস্তবায়ন করে। পর্যায়ক্রমে শোষণ রাজনীতির সূত্রপাত ঘটায়। বর্তমান বিশ্বের এ গণতন্ত্রবাদীরা বেশি সম্পদের মালিক। তারা ক্ষমতার মসনদে বসে ন্যায়নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার রঙিন চশমা পরে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট গঠন করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে। এক কথায় গরিব মারার ফাঁদ তৈয়ার করে। অসুস্থ রাজনৈতিক দলগুলো, ক্ষমতাকে একবার হস্তগত করতে পারলে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য মরণপণ যুদ্ধে নেমে পড়ে। এ যুদ্ধে মানুষ মনুষ্যত্ব হারায় এবং কে বন্ধু কে শত্রম্ন তা চেনার বোধশক্তি হারায়। সুবিধাবাদীরা, নেতার জন্য খরচ করে এক টাকা; এর পরিবর্তে লুটতরাজ ও আত্মসাৎ করে কোটিকোটি টাকা। এভাবে গড়ে তোলে মাফিয়া জগতে স্বর্গরাজ্য। সুযোগ সন্ধানীদের ভিড়ে ভালো মানুষ ও আদর্শবান রাজনৈতিকরা হারিয়ে যায়। চরিত্রবান রাজনীতিবিদরা এ ধরনের অসৎ কাজ হতে নিজেদের বিরত রাখেন।
গ্রন্থকার ও কলাম লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, 'ক্ষমতার রঙিন চশমা বিভ্রান্তিকর, বন্ধু শত্রম্ন বোঝা যায় না'। ক্ষমতা ও অর্থ এ দুটো জিনিস মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ক্ষমতার রঙিন চশমার কারণে অধিকাংশ মানুষের চক্ষুলজ্জা হারিয়ে যায় এবং হিংস্র মনোভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ক্ষমতা মানুষকে মমতাহীন করে তোলে। যার বাস্তবচিত্রে সমাজে অহরহ। চট্টগ্রামের সাবেক বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ও কলামিস্ট ইদ্রিস আলী বলেছিলেন, 'ক্ষমতা মমতাহীনতা ঔদ্ধত্যপূর্ণ অপদেবতা'। রাজনীতিতে প্রকৃত রাজনীতিবিদ ও আদর্শিক নেতার আবির্ভাব ঘটলে জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত হয়। পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এবং উন্নয়ন সূচিত হয়।
বর্তমানে অর্থ ও অযোগ্যতা রাজনীতির মাপকাটি। জনপ্রিয়তা এবং যোগ্যতা বর্তমান রাজনীতির মাপকাঠি নয়। বিচক্ষণ রাজনৈতিকদের কেউ নেতৃত্বের সারিতে আনতে চায় না। কারণ তারা ভয় করে। এ ভয়কে যারা নির্ভীকতায় রূপ দিতে পেরেছেন তারাই প্রকৃত রাজনৈতিক। এ গুণ খুবই কমসংখ্যক নেতাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, তন্মধ্যে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উলেস্নখযোগ্য। যারা ক্ষমতার সৎ ব্যবহার করে দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। এরা আলস্নাহর দরাবারে সম্মানিত। এ ব্যাপারে হাদিসে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেন, 'ন্যায়পরায়ণ শাসক তথা ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহারকারী কিয়ামতের দিন আলস্নাহর সর্বাধিক প্রিয় এবং সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবেন। আর অত্যাচারী শাসক আলস্নাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত ও সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। অধিকন্তু সে আলস্নাহর দরবার থেকেও বহুদূরে অবস্থান করবে' (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৭৯)। দায়িত্বের প্রতি সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, 'তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে' (বুখারি, হাদিস : ৮৫৩; মুসলিম, হাদিস : ৪৮২৮)। দায়িত্ব একটি আমানত স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে আলস্নাহ তা'আলা বলেন, আমানতের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এসেছে, 'নিশ্চয়ই আলস্নাহ তোমাদের নির্দেশ দেন-আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে' (সুরা নিসা : আয়াত : ৫)।
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, 'মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে'। মানুষ জ্ঞানী ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা করে কিন্তু নেতা বানায় না। মূর্খ, অযোগ্য ও অদক্ষদের নেতা বানায়। যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষগুলোকে সেমিনারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। আর অযোগ্যদের সংসদ পর্যন্ত পৌঁছায়। অযোগ্যতা যেখানে নেতৃত্ব দেবে সেখানে যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে না। এজন্য জ্ঞানী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ কখনো অনুগত হয় না; তবে বিনয়ী হয়। কারণ তারা অসত্যের কাছে মাথা নত করে না। রাজনীতির পরম সত্য কথা হলো- যোগ্যতার চেয়ে বিশ্বস্ততা বড়। পল্টিবাজ রাজনীতিতে এ দৃশ্যটি বারবার দেখা যায়। রাজনীতিতে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পথ চলতে পারাটা সফলতার প্রথম ধাপ। রাজনৈতিকভাবে মানুষ ভুল করলে ক্যারিয়ার সেখানেই ইতি টানে। তবে ভুল শোধরালে আলোর পথ দেখে।
ইতিহাসের চরম সত্য কথা হলো- ভুল আর অপরাধ এক নয়। ভুল অনিচ্ছা আর অপরাধ ইচ্ছায়; ভুল ক্ষমারযোগ্য আর অপরাধ বিচার যোগ্য। কোনো জিনিসকে ঢেকে রাখলে বেড়ে যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে খলিফাতুল মুসলেমিন হজরত মাওলা আলী (রা.) বলেছিলেন, অজ্ঞতা। এজন্য যারা অজ্ঞতা আর অহমিকাকে পরিত্যাগ করতে পেরেছে তারা সফলকাম হয়েছে।
কারণ- জন্মালেই মরতে হয়, শুরু করলে শেষ করতে হয়, উত্থান হলে পতন হয়। একটি পতনের জন্য একটি বিপস্নবের প্রয়োজন। পতনকে সুনিশ্চিত করতে পারে একটি উত্থান। উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করতে ব্যর্থ হলে পতন সুনিশ্চিত। আর প্রত্যেক বিপস্নবেই রয়েছে প্রসব বেদনা। ক্ষমতা আর জনপ্রিয়তা দুটি নিচে নামার সিঁড়ি। উপরে উঠলে নিচে নামতে হয়। উত্থান যেমন চিরস্থায়ী নয়। আবার পতনও চিরস্থায়ী নয়। রাজনীতিতে উত্থান এবং পতন একটি স্বাভাবিক ধারা। মানুষের অধঃপতনের অন্যতম কারণ হলো ক্ষমতার অপব্যবহার।
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো- সাহস আর আত্মবিশ্বাস। সব হারালে পাওয়া যায়। তবে সাহস হারালে নয়। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান ও শীর্ষস্থানীয় নেতা- তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, 'রাজনীতি আর অর্থনীতি হিমালয় পর্বত নয় যে, নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকবে'। রাজনীতি আর অর্থনীতি পরিবর্তনশীল। মুহূর্তের মধ্যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে পারে; এজন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থ হলে ক্ষমতার হাতবদল হবেই এটাই স্বাভাবিক। ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করলে রাজনৈতিক দল বেশিকাল টিকে থাকে না। বহু রাজনৈতিক দলের নাম ইতিহাসের পাতায়ও স্থান পায়নি। এমনও অনেক আছে, ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছে। এ রকম ঘটনা অহরহ। প্রকৃত নেতাদের ইতিহাস; ইতিহাসে পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকে। রাজনীতি আর ক্ষমতা ক্ষণিকের জন্য। এ অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের সেবা করতে পারাটা একজন সত্যিকারের মানুষের পরিচয়। কারণ রাজনীতিতে সত্য, মিথ্যা, শত্রম্ন, মিত্র বলতে কিছুই নেই। কারণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যেটি আজ চিরন্তন কাল সেটি চিরন্তন মিথ্যা। রাজনীতিতে আজকে যে শত্রম্ন কালকে সে মিত্রম্ন। রাজনীতি একটি নাটকের মঞ্চ। যে যত বেশি নাটকীয় ও ছলনাময় অভিনয় করতে পারবে রাজনীতিতে সে তত বেশি সফল। পরিশেষে বলব- রাজনীতি ও ক্ষমতা আলস্নাহর একটি নিয়ামত। এ নিয়ামত যাতে আমাদের জন্য কাল কিয়ামেতর ময়দানে কাটা হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখা দরকার। আলস্নাহ ছাড় দেয়; কিন্তু ছেড়ে দেয় না। এমন কাজ করা যাবে না- যেন কারও মোনাজাত; আমাদের নামটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে যেন আলস্নাহর বিচারের কাঠগড়ায় না দাঁড়ায়। সৃষ্টির চোখের পানির ফোঁটা আলস্নাহর কাছে খুবই দামি। এ চোখের পানি কারও ধ্বংসের কারণ আবার কারও উন্নতির কারণ। হে আলস্নাহ! আমাদের কল্যাণময় রাজনীতি করার সুযোগ দিও। অন্যায় ও অবিচারমূলক রাজনীতি থেকে দূরে রাখ।
কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
কর্মকর্তা- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, যাত্রাবাড়ী শাখা, ঢাকা