রোববার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন কাটিয়ে এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতি

বারবার ভুল সিদ্ধান্তে বিএনপিকে এখন চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। বিএনপি দলের অভ্যন্তরেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অবস্থা বিচারে বলা যায়, বারবার ব্যর্থতার বেড়াজাল বিএনপিকে গ্রাস করেছে। কারণ দীর্ঘদিন থেকে হুঙ্কার হুমকি ধমকি দেয়ার পরও কোনো কর্মসূচিতে উলেস্নখযোগ্যভাবে সফলতার মুখ দেখতে পায়নি বিএনপি। তাদের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে যেমন হতাশার সৃষ্টি করেছে তেমনি সরকারি দলে তৈরি হয়েছে আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্র।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
  ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন কাটিয়ে এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতি

অর্থনৈতিক সূচকে দেশের অগ্রগতি এখন বিশ্বে স্বীকৃত। এক সময় বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে শীর্ষে ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি তথা চারদলীয় জোট সরকারের সময় টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত ছিল। আর এখন দেশ উন্নয়নের রোল মডেল। একটি সময় ছিল আমাদের সমাজ, প্রশাসনসহ সর্বত্র বিরাজ করেছে দুর্নীতির প্রভাব। বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এবং বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা সাধারণ মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্য গত দুই বছর লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। সরকার স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য টিসিবিকে সক্রিয় করে এক বছর ন্যায্যমূল্যে কিছু পণ্য ক্রয় করার সুযোগ করে দেয়। বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। সব ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য জনসাধারণের নাগালের মধ্যে রাখার বিষয়টি নিয়ে সরকার ইতোমধ্যেই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদন, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সময় দেশের সাক্ষরতার হার প্রায় ২৫ শতাংশ ছিল। বর্তমানে তা ৭০ শতাংশের বেশি হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তি এখন ৯০ শতাংশের বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার, সর্বকালের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। তাদের মধ্যে ১৮.৭ শতাংশ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং অন্য ৫.৬ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। ১৯৭১ সালে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯১ ডলার। বর্তমানে তা প্রায় ৩ হাজার মার্কিন ডলার। নারীরা এখন আমাদের জাতীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।

অথচ এই বাংলাদেশের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ তার পরিবারের অধিকাংশ ব্যক্তি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আরাফাত রহমান কোকোর কয়েকটি ব্যাংক হিসাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মামলা করে- যা নম্বর ১:০৯-পা-০০০২১(ঔউই)। এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত ছিল। আরাফাত রহমান কোকো সিমেন্স এবং চাইনা হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাছ থেকে তার অ্যাকাউন্টে ঘুষ হিসেবে নিয়েছিল ওই টাকা।

মার্কিন ফেডারেল বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও মানিলন্ডারিং নিয়ে তদন্ত করেছে এবং বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এফবিআইয়ের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি। এফবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে যে, তারেক ও মামুন তাদের সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড-এর পরিচালক এবং চীনের হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন-এর এ দেশীয় এজেন্ট খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছিল।

২০১১ সালের ২৩ জুন কানাডার একটি আদালত বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসাইনের দুর্নীতি মামলার বিষয়ে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেয়েছিল। মোশাররফ কানাডার কোম্পানি নাইকোকে অনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে একটি দামি গাড়ি উপহার পেয়েছিল নাইকোর কাছ থেকে যার আর্থিক মূল্য ছিল কানাডিয়ান ডলারে ১,৯০,৯৮৪ ডলার।

২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন রমনা থানায় খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমান ও আরো চারজনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করে। অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা অরফানেজ ট্রাস্টের নামে দেশের এতিমদের জন্য বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ টাকার অনুদান আত্মসাৎ করে। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট কোর্টে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে ৫ বছর ও তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদন্ডের রায় ঘোষণা করে আদালত।।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন -এফবিআই'য়ের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি ডেবরা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ কয়েক বছর দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছেন। বাংলাদেশে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে দুর্নীতি হয়েছিল তা নিয়েই মূলত তিনি তদন্ত করেছেন। ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে এবং বিএনপির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে তিনি যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেখানে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং জিয়া পরিবার নিয়ে বাস্তবতার নিরীখে কিছু মন্তব্য করেন। সেই সময়ের সরকার এবং জিয়ার পরিবারের ঔদ্ধত্যের কারণে কীভাবে তখন দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি হয়েছিল তা তিনি তুলে ধরেন।

এমন অসংখ্য দুর্নীতির ঘটনা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছিল। সেই বাংলাদেশকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ নয়। তারপরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী টানা ক্ষমতায় রয়েছে জন্যই সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। দেশ এখন উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে।

আওয়ামী লীগ নতুনভাবে ধারাবাহিক সরকার গঠনের প্রায় ৬ মাস হতে চলেছে। সরকারি ক্ষমতায় থাকলেও মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে দলীয় কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সমালোচনা করছে। অথচ এই দল ক্ষমতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল। যেটি আওয়ামী লীগ কখনোই প্রশয় দেয় না। বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার, সেটি আদায়ের জন্য যে ধরনের জনমত গড়ে তোলা দরকার সেটি না করে অদূরদর্শী বক্তব্য প্রদানে ব্যস্ত রয়েছে। এই মুহূর্তে জনগণকে নিজেদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তৈরি করতে বিএনপির উচিত নিজস্ব কর্মসূচি ও দলীয় স্বার্থে নানাবিধ এজেন্ডা সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যাতে জনসমর্থন এবং জনমত বিএনপির পক্ষে যায়।

বারবার ভুল সিদ্ধান্তে বিএনপিকে এখন চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। বিএনপি দলের অভ্যন্তরেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অবস্থা বিচারে বলা যায়, বারবার ব্যর্থতার বেড়াজাল বিএনপিকে গ্রাস করেছে। কারণ দীর্ঘদিন থেকে হুঙ্কার হুমকি ধমকি দেয়ার পরও কোনো কর্মসূচিতে উলেস্নখযোগ্যভাবে সফলতার মুখ দেখতে পায়নি বিএনপি। তাদের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে যেমন হতাশার সৃষ্টি করেছে তেমনি সরকারি দলে তৈরি হয়েছে আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্র।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ংঁষঃধহসধযসঁফ.ৎধহধ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে