পরিবেশ সুরক্ষায় চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬ষ্ঠ স্থানে। তাপমাত্রা ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দেশে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। পাল্টে যাচ্ছে ঋতুর ধারাক্রম। ফলে মানুষের চিরচেনা স্বাভাবিক জীবন প্রবাহই আজ ব্যাহত।

প্রকাশ | ০৫ জুন ২০২৪, ০০:০০

ড. হারুন রশীদ
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস (সংক্ষেপে ডঊউ)। প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্ম উদ্যোগ আর জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। উইকি পিডিয়া বলছে, এই দিনটিতেই জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সম্মেলন (টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈড়হভবৎবহপব ড়হ :যব ঐঁসধহ ঊহারৎড়হসবহঃ) শুরু হয়েছিল। এই সম্মেলন হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ থেকে ১৬ জুন অবধি। এই সম্মেলনে ওই বছরই চালু করেছিল জাতিসংঘের সাধারণ সভা। তখন থেকেই প্রতি বছর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। প্রতি বছরই দিবসটি আলাদা আলাদা শহরে, আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- 'করবো ভূমি পুনরুদ্ধার রুখবো মরুময়তা, অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা।' প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে মানুষ তথা প্রাণিকুলের সঙ্গে সহাবস্থান করে কীভাবে একসঙ্গে চলে পরিবেশের আরও উন্নয়ন ঘটানো যায় সেটিই পরিবেশ সাংবাদিকতার মূল কথা। রিপোর্টে, ফিচারে, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এমনকি ফটোগ্রাফিতেও পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্যের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। পরিবেশ সাংবাদিকতা পরিবেশ আন্দোলনেরই শান্তিময় এক বাতাবরণ যেন। বাংলাদেশে নদী ও খালগুলোর দখল দূষণ বন্ধ না হওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দখল দূষণের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান এবং সামান্য জেল-জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে সবকিছু। অথচ পরিবেশ সচেতনতার এই যুগে নদী ও খালের দখল দূষণ বন্ধ এবং যথাযথভাবে তা রক্ষা করা সময়ের দাবি। ডাইং বর্জ্য তুরাগ নদীতে ফেলে দূষণের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। জরিমানাও করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু দূষণ বন্ধ হয় না। এসব বর্জ্যর মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর পস্নাস্টিক, পলিথিন, রাসায়নিকসামগ্রী, জৈব, অজৈব ও গৃহস্থালি বর্জ্য। শুধু তাই নয়, সাভার অঞ্চলের শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদী ও খালে। গাজীপুরের অবস্থাও একই। সেখানকার জমিজমা পর্যন্ত চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে শিল্পবর্জ্যর দূষণে। এ অবস্থায় এতদঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগব্যাধি। শিল্পকারখানা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মেনে চলে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদী-খাল দখল দূষণ দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। 'জোর যার মুলস্নুক তার' নীতিতে যে যেভাবে পারে এই দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সব শেয়ালের এক রা। প্রশাসনও এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্বিকার ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দখলদাররা এতটাই প্রভাবশালী থাকে যে, তারা আইন প্রশাসন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। অথচ নদনদীর টিকে থাকার সঙ্গে বলা যায় বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অস্তিত্বের সম্পর্ক জড়িত। কাজেই যে কোনো মূল্যে নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদী থেকে বালু উত্তোলন করার কারণেও নদীর অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, নদীর মধ্যে বালুমহাল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। সেই জায়গা ব্যতীত অন্য কোনো জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না। এক বছরের বেশি বালু মহাল ইজারা দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্র বিশেষে এই সময়সীমা আরও কম হতে পারে। রাতে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ। ইতোপূর্বে ঢাকার চারপাশের নদী বাঁচানোর জন্য হাইকোর্টকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। কিন্তু দখল বন্ধ হচ্ছে না। একদিকে উচ্ছেদ অভিযান চলে, অন্যদিকে, নতুন করে দখল হয়। এই সাপলুডু খেলায় শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় দখলকারীরাই। অথচ নদী দখল বন্ধ করতে না পারলে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিবেশ সচেতনতার এ যুগে নদীর অপমৃতু্য হবে আর সবাই চেয়ে চেয়ে দেখবে এটা হতে পারে না। দখলকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া নদী দখল বন্ধ করা যাবে না। নদী দখলে একটি দুষ্টচক্র অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। এ চক্র ভাঙতে হবে। প্রশাসনের কোনো গাফিলতি থাকলে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা নদীমাতৃক বাংলাদেশকে তার আপন মহিমায় দেখতে চাই। দিন পাল্টেছে। কৃষিতে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রযুক্তি। নতুন নতুন উদ্ভাবন আমাদের কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ। সারা বছরই পাওয়া যাচ্ছে সব ধরনের সবজি, ফসল। মাছ-মাংস উৎপাদনেও ঘটেছে বিপস্নব। বিশেষ করে মাছ চাষ বদলে দিয়েছে চাষিদের ভাগ্য। এমনও বলা হচ্ছে, মাছই বদলে দেবে বাংলাদেশকে। মাছ উৎপাদনে বিপস্নব ঘটেছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন তা রপ্তানিও হচ্ছে। অ্যাকুরিয়ামের রঙিন মাছ চড়া দামে কিনে আনতে হতো সিঙ্গাপুর থেকে, এখন তা দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। মাছ চাষের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছে না। মাছচাষ করতে হলে তো জল বা জলাশয়ের দরকার। জলই যদি না থাকে, তাহলে মাছ থাকবে কেমন করে? জলের আধার হচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল। দেশের নদ-নদীগুলো দখল-দূষণে হারিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। দেশে এখন মাছ উৎপাদনে একটি বিপস্নব ঘটেছে। বাণিজ্যিকভাবে অনেকে লাভবান হচ্ছে। মাছের উৎপাদন বেড়েছে বটে, কিন্তু তাতে পুষ্টি চাহিদা মিটছে না। এজন্য দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। প্রাকৃতিকভাবেই যেন দেশি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত মাছে ভাতে বাঙালিকে প্রাকৃতিক মাছের অতুলনীয় স্বাদ ফিরিয়ে দিতে হলে দেশের নদী-নালা-খাল-বিলগুলো বাঁচাতে হবে সবার আগে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে ৫৪ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ প্রায় বিলুপ্ত, ২৮ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। এর প্রধান কারণ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল-নদী-নালাশূন্য। খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব। যেসব নদী অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোয় দূষণের মাত্রা এত বেশি, মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গিন। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের পর বুড়িগঙ্গা তার রূপ ফিরে পাচ্ছে, এটা আশার কথা। একইভাবে অন্য নদনদীগুলোও দূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক নদীর নাম হালদা। চট্টগ্রামের ব্যতিক্রমী এই নদীতেই পূর্ণিমা-অমাবস্যার একটি বিশেষ সময়ে মাছ ডিম ছাড়ে। বহুসংখ্যক মানুষের জীবনজীবিকা নির্বাহ হয় এই নদীকে কেন্দ্র করেই। নদীর পানিও ভূ-উপরিস্থ জলের আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শহরে এই নদী থেকেই পানি শোধন করে তা পানের জন্য সরবরাহ করা হয়। অথচ দখল-দূষণে এই নদীও মৃতপ্রায়। হালদা দখল করে হচ্ছে ইটভাটা, বসতবাড়ি। এটা এক আত্মঘাতী প্রবণতা। যেখান থেকে শত শত মণ মাছের ডিম উৎপাদন হয়, সেখানে এখন এক মণ ডিম পাওয়াও দুষ্কর। ফলে মাছের অভাব যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি নদী তীরবর্তী বহুসংখ্যক মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এটা মনে রাখা দরকার, হালদা নদী বাঁচলেই প্রাকৃতিক মাছের বিশাল এক ভান্ডার রক্ষা পাবে। হালদা একটি বিশেষ ধরনের নদী, একে রক্ষা করতে হবে যে কোনো মূল্যে। সুন্দরবন যেমন অনন্য, আমাদের দেশকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরছে এর রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে, তেমনি হালদাও। একটি সুন্দরবন যেমন কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তেমনি হালদাও। এই বিশিষ্টতার মূল্য দিতে জানতে হবে। কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল ও জলাশয়গুলোয় গিয়ে পড়ে এবং মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। বর্তমানে মৎস্য চাষিরা এমন প্রজাতির মাছচাষ করছেন, যেগুলো অতি অল্প সময়ে দ্রম্নত বর্ধনশীল। শুধু বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক এসব মাছ চাষের কারণে এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছ চাষ করার ব্যাপারে অনীহার কারণেও আমরা হারিয়ে ফেলছি দেশীয় জাতের নানা মাছ। চাষের মাছে কোনো স্বাদ নেই। অথচ ছোট-বড় নানা জাতের দেশি মাছের স্বাদ, সে তো অতুলনীয়! এছাড়া প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা ও জাটকা নিধনের কারণে রূপালি ইলিশও বিলুপ্তির পথে। ইলিশ রক্ষার বিষয়ে নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায়। ইলিশের ব্যবস্থাপনা নিয়ে এর আগে 'আন্তঃসীমান্ত সংলাপ'ও হয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, ভারতের কার্যকর সহযোগিতা ছাড়া ইলিশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সম্ভব নয়। কারণ বাংলদেশ ও ভারতের বেশ কিছু অভিন্ন নদী রয়েছে। পদ্মাসহ বেশ কিছু নদী ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। দুয়েকটি নদীর উজানে বাঁধ দেওয়ায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্রোত তো দূরের কথা, যদি পর্যাপ্ত পানি না থাকে, তবে ইলিশ বাঁচবে কীভাবে? ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের পদ্মাসহ কয়েকটি নদীর জীর্ণদশা। বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ইলিশের উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ শুরু হলে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। যে পদ্মা নদী ছিল ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র, সেই নদীই এখন মৃতপ্রায়। এখানে-ওখানে বড় বড় চর পড়ে একদার প্রমত্তা পদ্মার মৃতপ্রায় ঘনিয়ে এসেছে। শুধু বর্ষাকালের তিন-চার মাস ছাড়া সারা বছর নদীতে পানি থাকে না বললেই চলে। দেশের অন্য নদীগুলোরও একই অবস্থা। তাহলে আমাদের প্রিয় মাছ ইলিশ কোথায় যাবে? কোথায় অবাধে তার বংশবৃদ্ধি হবে, যেখানে ছোট জাটকা সহজেই বেড়ে একটি উপাদেয় ইলিশে পরিণত হবে? আসলে প্রায় দুই যুগ ধরে যেন ইলিশের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ইলিশ একদিন বিলুপ্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই ইলিশবান্ধব একটি প্রতিবেশ তৈরির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। হারানো নদী পুনরুদ্ধার, নদীর নাব্য বৃদ্ধি, নদীদূষণ রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মৎস্যচাষিদের দেশীয় মাছচাষের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সংকটের কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বন। আমাদের ঐতিহ্য সুন্দরবন, মধুপুরের শালবন, পার্বত্য অঞ্চলের বন-বনানী আজ ধ্বংসের মুখে। চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। একটু বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। পরিবেশ বিষয়ক আইন ও বিধি বিধানের ফাঁকফোকর দিয়ে চলছে নির্বিচার এ ধ্বংসযজ্ঞ। লাখো-কোটি বছর ধরে একটি পাহাড় সৃষ্টি হয়। মানুষের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের কারণে সেই পাহাড় কেটে তারা বসতি স্থাপন করছেন। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে মারাত্মকভাবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। অথচ মাত্র এক মিটার উচ্চতা বাড়লেই দেশের সাড়ে ১৭ ভাগ ভূমি সাগরতলে হারিয়ে যাবে চিরতরে। ভাবা যায়! এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে নু্যব্জ বাংলাদেশ। সাগরতলে ভূমি হারিয়ে গেলে কয়েক কোটি লোক পরিবেশ আর জলবায়ু শরণার্থী হবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে যে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনও সাগর কোলে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে মারাত্মকভাবে। এ অবস্থায় টেকসই পরিবেশ বজায় রাখাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন আমাদের জন্য প্রকৃতির এক অপরূপ দান। ঝড়ঝাপ্টা থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক অনেক দুর্যোগ হতে রক্ষা করে সুন্দরবন। এখানকার জীববৈচিত্র্য এই বনকে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবনে রয়েছে ৫ হাজার প্রজাতির সম্পূরক উদ্ভিদ, ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির চিংড়ি মাছ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ। এই বনকে ঘিরেই বহু মানুষের জীবনজীবিকা চলছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পেও সুন্দরবন এক অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে সুন্দরবন আজ নানা কারণেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। অথচ এই বনকে রক্ষা করতে না পারলে জলবায়ুর পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশকে আরও দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে। এজন্য সুন্দরবন রক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। পানি দূষণ, বায়ূ দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, মাটি দূষণ আরও জটিল করে তুলছে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ সমস্যাকে। রাজধানী ঢাকা এখন নানা দিক থেকেই বাস অনুপযোগী শহর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লোকজনকে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। যত্রতত্র যখন তখন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলার। সকালবেলা বাসাবাড়ি থেকে বের হয়ে লোকজনকে রীতিমতো ধুলায় গোসল করে ফিরতে হয়। ওয়াসা, ডেসা, তিতাস- এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে কাজ শেষ করে তো আরেক সংস্থা শুরু করে। এতে যেমন রাষ্ট্রের অর্থের শ্রাদ্ধ হয় তেমনি ভোগান্তিও বাড়ে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের কাজের কোনো সমন্বয় না থাকায় যুগ যুগ ধরে চলছে এই জগাখিচুড়ি অবস্থা। বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটা বারবার বিভিন্ন জরিপে ওঠে আসছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ইপিএর প্রতিবেদনে বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের যে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে তা উদ্বেগজনক। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাতাস দূষিত এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গত এক যুগে ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে। এর আগেও বিভিন্ন জরিপে বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার শোচনীয় অবস্থার কথা ওঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬ষ্ঠ স্থানে। তাপমাত্রা ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দেশে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। পাল্টে যাচ্ছে ঋতুর ধারাক্রম। ফলে মানুষের চিরচেনা স্বাভাবিক জীবন প্রবাহই আজ ব্যাহত। এ কারণে প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণিকুলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। লেখার মাধ্যমে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশবাদী সংগঠন নিয়ে বেশি করে খবর প্রকাশ করতে হবে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। পরিবেশ সংক্রান্ত আইন-কানুন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাও পরিবেশ সাংবাদিকতার অংশ। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে, আছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের কার্যক্রম নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশ সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি ও পরিধি বাড়াতে হবে এবং তা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই। ড. হারুন রশীদ :সাংবাদিক ও কলামিস্ট ফৎযধৎঁহ.ঢ়ৎবংং@মসধরষ.পড়স