শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে

আর কে চৌধুরী
  ০৪ জুন ২০২৪, ০০:০০
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে

সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দেওয়া। জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে মান বৃদ্ধি করতে পারলে সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। দিন যত যাচ্ছে, জীবনযাত্রার ব্যয় তত বাড়ছে। কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়ছে না। ফলে, সংকট দেখা দিচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে। সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছে স্থির আয়ের মানুষ। এই মাসে জাতীয় বাজেট পেশ করা হবে। নতুন অর্থবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বাড়বে। কারণ আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে রাজস্ব আদায়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির জেরে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেলেও বাড়ানো হচ্ছে না করমুক্ত আয়সীমা। বর্তমানে ৩৭ লাখ ব্যক্তি শ্রেণির করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে বড় অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির করদাতা। এই শ্রেণির করদাতাদের জন্য বাজেটে আয়কর খাতে ছাড় থাকছে না। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও আয়কর আদায়ের কথা চিন্তা করে বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। তবে করদাতা হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। অনেক পণ্যে ভ্যাটহার ১৫ শতাংশ করায় এর প্রভাব পড়বে বাজারে। অন্যদিকে, চাল, গম, ভুট্টা, সরিষাবীজ, পরিশোধিত সয়াবিন, পাম অয়েল, সানফ্লাওয়ার বীজ, তুলাবীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, ক্রুড অয়েল, সার, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিটুমিন, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, ইনসুলিন, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের অত্যাবশ্যক ওষুধ এবং ভ্যাকসিন ও ওষুধের কাঁচামাল, বিভিন্ন ধরনের দরকারি রাসায়নিক ইত্যাদির ওপর বসতে যাচ্ছে বাড়তি শুল্ক। পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে মোবাইল ফোনে কথা বলতে গেলে বা ইন্টারনেট ব্যবহারে গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। তবে ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তই নয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নাকাল মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তরাও। বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্য উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। অন্যদিকে, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চাহিদায় কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সর্বশেষ তথ্য মতে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ- যা এক বছর আগেও এর অর্ধেক ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা এবং ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ট্যাক্সের পরিমাণও বেড়ে যায়। এতেও মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে। ফলে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য, যেগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে, সেগুলোতে করের বোঝা শূন্য কিংবা সহনীয় পর্যায়ে রাখা উচিত। সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দেওয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের যাতে ক্রয়ক্ষমতা ও আয়-রোজগার বাড়ে, সেটার ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি আরো বাড়ানোর বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের পরামর্শ, সরকারের বাজেট প্রস্তাবে সংকট সমাধানের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ থাকতে হবে। আসছে অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির কারণে বিপাকে পড়া মানুষকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন তারা। জানা গেছে, স্বল্প আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া খোলা ট্রাকে খাদ্যশস্য বিক্রি কার্যক্রম বাড়ানো হবে। টিসিবির মাধ্যমে বর্তমানে এক কোটি পরিবার কম মূল্যে খাদ্যপণ্য পাচ্ছে। ভবিষ্যতে পরিবার এবং পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ১১৫টি কর্মসূচিতে মোট এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এ বরাদ্দ মোট চলতি বাজেটের ১৬.৫৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৫২ শতাংশ। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয় ২৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদের হারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম এবং কৃষিসহ বেশ কিছু ভর্তুকি সামাজিক সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত থাকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চলতি বাজেটের মতো নতুন বাজেটেও জিডিপির প্রায় একই হারে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে সারের দাম অর্ধেক পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু তার কোনো প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়েনি। এর আগে বিশ্ববাজারে যখন দাম বেড়েছিল, সেই অজুহাত দেখিয়ে দেশের বাজারে কয়েক দফা সারের দাম বাড়ানো হয়েছিল। আবার ডিজেল ও বিদু্যতের দাম বাড়ার কারণে পানি সেচ কাজের ব্যয় বেড়েছে। মূলত এসব কারণে পণ্যের দাম কমছে না।

আমাদের নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে জোর দিতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে না পারলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। চারদিক দিয়েই লাগামহীনভাবে ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় আয় না বাড়ায় বর্তমানে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

দুই বছর আগে বাজারে সোনালি মুরগির দাম ছিল কেজি ২৫০ টাকা, সেই মুরগির দাম বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ৩৬০ টাকা। একইভাবে গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে সব ধরনের পণ্যের দাম অনেক বেশি। ফলে বাচ্চাদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব কারণে সরকারকে আগামী বাজেটে বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। না হলে আগামী দিনে আমাদের মতো নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের টিকে থাকা কঠিন হবে।

আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে