শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

কর্মঘণ্টা নষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়

হিরা তালুকদার
  ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০
কর্মঘণ্টা নষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়

কর্মস্থলে অবস্থানরত মহামূল্যবান মুহূর্তকে কর্মঘণ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বর্তমান বাংলাদেশের সেরা সমস্যাগুলোর মধ্যে কর্মঘণ্টা অন্যতম। আর কর্মঘণ্টা নষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ হলো যানজট। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অসহনীয় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজধানী মহানগর খ্যাত ঢাকায় ৭৩টি মোড়ে আটকে যাচ্ছে যানবাহন। এতে করে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি পুরছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার।

সম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, চরম যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৯০ লাখের অধিক কর্মঘণ্টা। এই সর্বনাশা যানজটের কারণে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ১৫২ কোটি ৫৬ লাখের অধিক টাকা। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে প্রতিবছর সব মিলিয়ে এক হাজার ৪০০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ১৪০ কোটি টাকা। কর্মঘণ্টার নষ্টের পেছনে রয়েছে যানজট, যা দেশবাসীর জন্য বড় শঙ্কার কারণ।

নানামুখী সমস্যার কারণে মানুষের স্রোত আর অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি রাজধানীতে যানজটের সৃষ্টি করছে। রাজধানীবাসীর কাছে যানজট একটি মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রতিদিনের অসহ্য যানজটের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা। হুমকিতে পড়ে বেঁচে থাকার চিন্তা। তেমনিভাবে চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা কিংবা অবরোধ, হরতালের দিনে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়কে দেখা যায় তীব্র যানজট। জীবনাচরণ হয়ে পড়ে স্থবির, মানুষ হয়ে ওঠে নাকাল। পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব ঢাকা শহরে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ ৭৩ হাজার ১৬০টি। এর মধ্যে মোটর সাইকেলের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ৫২ হাজার ৬৭৪টি। যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার ৭৮২টি। এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে চলাচলকৃত ৫০ শতাংশ ব্যক্তিগত যানবাহন। আর এই ৫০ শতাংশ গাড়ি বহন করে মাত্র ১২ শতাংশ যাত্রী। কিন্তু বাকি ৫০ শতাংশ গাড়ি বহন করে ৮৮ শতাংশ যাত্রী।

যানজট বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো- ব্যক্তিগত যানবাহন বৃদ্ধি। যার ফলে বিপুলসংখ্যক যানবাহনের চাপে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। নগরীর জীবনমান, শিক্ষার উন্নতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় সুবিধা প্রভৃতির কারণে প্রতিনিয়ত রাজধানীতে মানুষের আগমন বাড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশেষ করে বন্যাকবলিত এলাকা, নদী-ভাঙন ও দুর্ভিক্ষ অঞ্চলের গরিব ও অসহায় মানুষের একমাত্র কর্মসংস্থানের জায়গা হিসেবে পছন্দ রাজধানী ঢাকা। সড়ক ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন চলাচল, যেখানে-সেখানে ইচ্ছামতো গাড়ি পার্কিং, অবৈধ ফুটপাত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ প্রভৃতি যানজট বাড়িয়ে তুলছে।

রাজধানীজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর ও হাটবাজার গড়ে উঠছে, যার ফলে রাস্তাঘাট সরু হয়ে যাওয়ার ফলে যানজট বাড়ছে দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝরছে তাজা প্রাণ। এ ছাড়া সড়কে একদিকে ধীরগতির রিকশা, ভ্যান ও অন্যদিকে দ্রম্নতগতিসম্পন্ন গাড়ি ও বাস-ট্রাকের যাতায়াতের ফলে গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, যার ফলে ঘটে দুর্ঘটনা আর দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনাকবলিত এলাকায় শুরু হয় তীব্র যানজট।

চট্টগ্রামের যানজট পরিস্থিতি ইদানীং আবারও খারাপ হয়েছে। আগ্রাবাদ এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কারণে যানজট বৃদ্ধি পেলেও শহরের অন্যান্য স্থানে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণেই যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে- যা বলা বাহুল্য মাত্র। যানজটের কারণে ১০ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। পরিকল্পনামাফিক সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে সময়ের কাজ সময়ে করা যায় না, মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।

শহরের প্রবেশ মুখ বলে খ্যাত সিটিগেট থেকে এ. কে.খান মোড় ও অলঙ্কার মোড়ে সার্বক্ষণিক যানজট লেগে থাকে। ফেনী থেকে কুমিরা আসতে যতক্ষণ সময় লাগে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে সিটিগেট থেকে জিইসি মোড় আসতে। এদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশমুখ বলে খ্যাত কর্ণফুলী ব্রিজের যানজট ইতোমধ্যে দেশব্যাপী খ্যাতিও পেয়েছে। বহদ্দারহাট, কোতোয়ালি হতে গাড়িগুলো গিয়ে ব্রিজের গোলচত্বর গিয়ে আটকে যায়। কর্ণফুলী ব্রিজের গোলচত্বরে যেন দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িসমূহের ইচ্ছামত যানজট সৃষ্টি করার লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাঠ। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারগামী যাত্রীবাহী বাসসমূহ রাস্তায় এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ সাহেবরা অদূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন। সেখানকার যাত্রীবাহী বাসসমূহ কোনো কিছুকেই কেয়ার করে না, ফলে অন্য যানবাহনগুলো অসহায়ের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। একই অবস্থা নগরীর আর দুটি প্রবেশপথ বহদ্দারহাট ও অক্সিজেন এলাকায়ও দেখা যায়। অক্সিজেন গোলচত্বর পার হতে ত্রিশ-চলিস্নশ মিনিট লেগে যায়। অক্সিজেন মোড়ের যানজট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে মানুষের কষ্টও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশে এই যানজটের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের পটভূমিতে যানজটের নিম্নলিখিত কারণগুলো শনাক্ত করা যায় : ১. সংকীর্ণ ও অনুন্নত রাস্তাঘাট ২. জনসংখ্যা ও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ৩. বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের একই সঙ্গে চলাচল ৪. ত্রম্নটিপূর্ণ ট্রাফিক ব্যবস্থা ৫. চালকদের অদক্ষতা ও হীন মানসিকতা। এই সমস্যার সমাধানকল্পে কয়েকটি প্রস্তাব, যা বাস্তবায়ন হলে যানজটের সমস্যা থেকে ঢাকাবাসী মুক্তি পেতে পারেন। (১) যেসব শহরে আগে যানজট ছিল এখন নিয়ন্ত্রিত যানজট; সেসব দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আমাদের এ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে যানজট নিরসনে পরামর্শ নেওয়া। (২) সরকার যানজট সমস্যা নিরসনে দেশি ও বিদেশি সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের পরামর্শ দিতে ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিবে। (৩) রাজধানী শহরতলী কাঁচপুরের যানজট নিরসনে যাদের ভূমিকা রয়েছে, তাদের ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে কাজে লাগানো যেতে পারে। (৪) রাজধানী ঢাকার প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাধিক্য যানজটের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়। (৫) অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ফুটপাত ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। (৬) রেল ক্রসিংগুলোতে ওভারব্রিজ তৈরি করলে যানজট অনেকাংশে নিরসন হবে। (৭) গাড়িচালককে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা ও গাড়ি ঘোরানো

থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা দরকার। (৮) রাজধানীতে সৎ, পরিশ্রমী এবং সাহসী ট্রাফিক পুলিশ অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। (৯) সরকার যানজট নিরসনের বিষয়ে অধিক মনোযোগী হবে।

মোটকথা, এক বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হয় যানজটে। এ ছাড়া যানবাহন চলাচলে ট্রাফিক নিয়ম অমান্য করার ফলে যানজটের ঘটনা নিয়মিতই রয়ে গেছে বছরের পর বছর। ঢাকার রাস্তায় যানবাহন বৃদ্ধির সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে যানজট। নগরীতে সাধারণ মানুষের জন্য একমাত্র ভরসা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। প্রতিটি বাসে প্রায় ৫০-৬০ জন মানুষের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। চলমান মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে রাজধানীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর যোগাযোগ স্থাপিত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে ধীরগতি ও দ্রম্নতগতিসম্পন্ন যানের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, তা নিয়েও কাজ করতে হবে।

যানজট সমস্যার সমাধান করতে পারলেই রক্ষা পাবে জনগণ। সময়ের সঠিক ব্যবহার হবে দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন করার জন্য যানজট সমূলে উৎপাটন করা প্রয়োজন। এর ফলে আর নষ্ট হবে না রাজধানীতে বসবাসরত মানুষের কর্মঘণ্টা। উপরন্তু তা দেশের সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান সহায়ক হয়ে উঠবে।

হিরা তালুকদার

বাংলা বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে