শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

নিরাপদ পরিবেশ ও খাদ্যের জন্য জৈব কৃষি

জৈব কৃষিক্ষেত্র মাটিতে অধিক কার্বন সংরক্ষণে সহায়তা করে, মাটির ক্ষয় রোধ করে ও মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য জৈব কৃষির বিকল্প নেই।
অমল বড়ুয়া
  ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০
নিরাপদ পরিবেশ ও খাদ্যের জন্য জৈব কৃষি

নিরাপদ খাদ্যের সংকটে পুরো পৃথিবী। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় জনস্বাস্থ্যের তুলনায় আর্থিক মুনাফাকে বড় করে দেখা হয়। ফলে উৎপাদনের সব পর্যায়ে এমন সব দোআঁশলা (হাইব্রিড) উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে- যা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করলেও মানবস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্তমানে শাকসবজি ও খাদ্য উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশক, উচ্চমাত্রার রাসায়নিক সার ও পচনরোধে ক্ষতিকর ফরমালিনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক উচ্চমাত্রায় যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে শাকসবজি সংগ্রহের পর তাতে বিভিন্ন জীবাণুর উপস্থিতি ও শাকসবজি পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত দূষিত পানি ইত্যাদি। এতে শাকসবজি গ্রহণ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ফলে অধিকাংশ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এখন দিনকে দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজির দিকে। জৈব চাষ হচ্ছে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা- যা পরিবেশগতভাবে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং জৈবিক সার ব্যবহার করে- যা মূলত প্রাণী ও উদ্ভিদের বর্জ্য এবং নাইট্রোজেন-ফিক্সিং থেকে প্রাপ্ত ফসল আবরণ। প্রচলিত কৃষির তুলনায়, জৈব চাষে কম কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, মাটির ক্ষয় হ্রাস করে, ভূগর্ভস্থ পানি এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানিতে নাইট্রেটের লিচিং হ্রাস করে। এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং কোনো রাসায়নিক দ্রব্য চাষ কাজে ব্যবহার করা হয় না। এতে ফসল দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ও নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদন অনেকটা নিশ্চিত হয়।

সুপ্রাচীনকাল থেকে জৈব পদ্ধতিতেই চাষাবাদ হয়ে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দ্রম্নত পরিবর্তনশীল কৃষি চর্চাসমূহের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জৈব খামার ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ১৯৩০ সালে জৈব কৃষির জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে লর্ড নর্থবোর্ন তার লেখা 'লুক টু দ্য ল্যান্ড' নামক বইয়ে প্রথম অর্গানিক ফার্মিং শব্দ ব্যবহার করেন। রাসায়নিক সারের ওপর ক্রমেই কৃষকদের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই আন্দোলন শুরু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম সুপার ফসফেট সার তৈরি শুরু হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যামোনিয়া থেকে উদ্ভূত সারসমূহ তৈরি শুরু হয়। এই সারসমূহ কম পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়, তাড়াতাড়ি কাজ করে অর্থাৎ খুব শক্তিশালী, দামে সস্তা এবং পরিবহণে সুবিধা হওয়ায় রাসায়নিক সার দ্রম্নত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। অনুরূপভাবে ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে রাসায়নিক বালাইনাশকের এমন অগ্রগতি ঘটে যে, ওই দশকের শেষের দিকে রাসায়নিক বালাইনাশকের যুগ শুরু হয়। স্যার আলবার্ট হাওয়ার্ডকে জৈব কৃষির জনক বলে বিবেচনা করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে জে. আই. রডেল, যুক্তরাজ্যে লেডি ইভ বেলফোর এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরও অনেকে জৈব কৃষির ওপর কাজ করেন। ১৯৯০ সাল থেকে জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্যের বাজার দ্রম্নত বৃদ্ধি পেতে থাকে। জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জৈব পদ্ধতিতে চাষকৃত এলাকাও বাড়তে থাকে। পৃথিবীর প্রায় ৩ কোটি ২২ লাখ হেক্টর জমিতে এখন জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষ হচ্ছে। এটা পৃথিবীর মোট আবাদি জমির শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। পাশাপাশি স্থানীয় জাতের জৈব পদ্ধতিতে আবাদ হয়েছে ৩ কোটি হেক্টরে।

\হ২০১২ সালে বাজারের আয়তন ছিল প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এই চাহিদার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জৈব উপায়ে পরিচালিত খামারভূমির পরিমাণও চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হারে এসব জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর (১৯ কোটি একর) জমিতে জৈব উপায়ে কৃষিকাজ সম্পাদন করা হয়- যা কিনা বিশ্বের মোট আবাদি জমির মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক জমিই অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থিত।

জৈব কৃষিব্যবস্থার উপকারিতা অনেক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা, সুস্বাস্থ্য, খাদ্য সরবরাহে নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই কৃষির বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে। জৈব কৃষিব্যবস্থার কারণে ভূমি ও পানিতে রাসায়নিক দূষণ কমে, পানি সম্পদের সংরক্ষণ হয় এবং এতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জৈব কৃষিব্যবস্থা দ্রব্যতে কোনো রাসায়নিক কীটনাশক অবশিষ্ট থাকে না এবং এগুলোর পুষ্টিমান উচ্চ হয়ে থাকে- যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অধিকন্তু জৈব কৃষিব্যবস্থা আর্থসামাজিক কল্যাণ, স্থানীয় উৎপাদক তথা গ্রামীণ জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশ্বব্যাপী নাইট্রোজেনের ব্যবহার গত ৫০ বছরে ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নাইট্রোজেনের ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ নদী এবং অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মিশে যায়। ফলে পানি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়ে। অর্গানিক চাষাবাদে যেহেতু কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার ব্যবহৃত হয় না। তাই বর্ধিত ঝুঁকিগুলোও সেখানে থাকে না। গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম সার ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করলে ৫০ বছরের মধ্যেই জমির নাইট্রোজেন ও কার্বন প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ হ্রাস পায় এবং একপর্যায়ে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়ে। আমেরিকার রোডেল ইনস্টিটিউট, ২৩ বছরব্যাপী অর্গানিক ফার্মিংয়ের কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ ক্ষমতার ওপর এক গবেষণা পরিচালনা করে দেখতে পায় যে, আমেরিকার সমস্ত চাষের জমিতে যদি অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়, তাহলে বছরে প্রায় ৫৮০ বিলিয়ন পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ু থেকে মাটি শোষণ করে নেবে। যা পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। জৈব চাষাবাদে জৈব বস্তু ব্যবহার করে মাটির প্রয়োজনীয় তাপ ও উপকারী জীবাণু সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া মাটির ক্ষয় কম হয় বিধায় এ পদ্ধতিতে উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পায়।

বর্তমান চাষাবাদে রাসায়নিক কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার এবং একই ধরনের ফসল বারবার চাষের কারণে অনেক মূল্যবান প্রজাতির শস্য স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে। তাছাড়া এই বিষাক্ত উপাদানসমূহ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনেক পশুপাখি এবং ক্ষুদ্রপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রচলিত কৃষি পদ্ধতি সিনথেটিক সার বিশেষ করে নাইট্রোজেনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। জৈব চাষাবাদে কৃত্রিম সিনথেটিক বস্তুর পরিবর্তে জৈব বস্তু ব্যবহার করা হয়- যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, পোকামাকড়, পাখি এবং প্রাণির জন্য একটি স্বর্গরাজ্য তৈরি করে। দি জার্নাল অব বায়োলজিক্যাল কনজার্ভেশন-২০০৫ এ উদ্ভিদ, মাটি, জীবাণু, মাকড়সা, প্রজাপতি, কীট, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর অর্গানিক ও প্রচলিত ফার্মিংয়ের প্রভাব নিয়ে ৬টি গবেষণাপত্র পর্যালোচিত হয়। এ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, অর্গানিক ফার্মগুলোতে প্রজাতির প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধি বেশি থাকে।

জৈব চাষাবাদে তুলনামূলকভাবে কম শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্ট ফর এনভায়রনমেন্ট ফুড অ্যান্ড রুরাল অ্যাফায়ার্সের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ পদ্ধতিতে শস্য উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে শক্তির ব্যয় ৩৫ শতাংশ কম হয়। এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখতে পান যে, প্রচলিত ফার্মিং পদ্ধতি সাপেক্ষে অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতিতে কেবলমাত্র ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ শক্তি ব্যবহৃত হয়। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অপরচুনিটিস অন অর্গানিক ফার্মসের মতে, জৈব চাষের জন্য বাংলাদেশের জমি সবচেয়ে উপযুক্ত। তাদের মতে, বাংলাদেশের মাটির ভলিউম এবং সূর্যালোকের প্রাচুর্যের কারণেই খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সমানুপাতিক হারে বায়োমাস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ডবিস্নউডবিস্নউওওএফের উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় এখানে প্রাকৃতিক কৃষি চাষাবাদের সম্ভাবনা অনেক। এখানে তাপমাত্রা কখনো মাইনাসের নিচে নামে না। ফলে সারা বছর প্রকৃতিতে জৈব উপাদানের প্রাচুর্য বজায় থাকে। এর ফলে, গাছপালাও পুষ্ট হয়, প্রকৃতিও সতেজ ও সবুজ থাকে। এ আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক চাষাবাদে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ- যা সারা বিশ্বের জন্য মডেল হতে পারে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে জৈবভাবে উৎপাদিত শস্য প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শস্যের চেয়ে ১৮০ গুণ কম রাসায়নিক পদার্থ পরিবহণ করে- যা মূলত আসে অজৈব সার এবং কীটনাশক থেকে।

\হজৈব কৃষিক্ষেত্র মাটিতে অধিক কার্বন সংরক্ষণে সহায়তা করে, মাটির ক্ষয় রোধ করে ও মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য জৈব কৃষির বিকল্প নেই।

অমল বড়ুয়া :প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে