পাঠক মত

ভার্চুয়াল জগৎ ও শিশুর মেধা বিনষ্ট

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০

এস এম জসিম শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জ
আসক্তি কথাটি নেশা ও অতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহার উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কেননা অনলাইন আসক্তি নেশা করা থেকেও বিপজ্জনক। ব্রেইন স্ক্যান ফলাফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি আর অনলাইন আসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক মিল দেখা যায়। তাদের মধ্যে মস্তিষ্কের একই রকমের ছবি দেখা গেছে। দুই দলের মানুষেরই মস্তিষ্কের সামনের দিকের হোয়াইট ম্যাটারগুলো ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখা যায় ব্রেইন স্ক্যানে। মানুষের আবেগ, মনোযোগ আর সিদ্ধান্তগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেইনের এই হোয়াইট ম্যাটার অংশ। অনলাইন আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন 'ডিজিটাল কোকেন'। উপকারী বিষয় ব্যতিরেকে নেশার জগতে ধাবিত হচ্ছে অনলাইন বা ভার্চুয়াল জগৎ। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য এটা একটা জীবন ঘাতক। গবেষক দল ৫১২ জন বাবা-মাকে নিয়ে একটা অনলাইন সার্ভে করেছিলেন যাদের সন্তান অনলাইন ব্যবহার করে। গবেষণায় দেখা গেছে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে গড়ে ২১.৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও আচরণগত সমস্যায় ভুগেছে। মানসিক সমস্যায় ভোগে ১০.২ শতাংশ এবং আচরণগত সমস্যা হয়েছে ২৬.৮ শতাংশের। অতিচাঞ্চল্য (হাইপার অ্যাক্টিভিটি) ছিল ১৯.৯ শতাংশের মধ্যে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ৩৬.৫ শতাংশের। আবার অন্যদিকে, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছেন অথবা অনলাইনে গেম খেলেছেন এমন শতকরা ৭৯ জন মানুষই সাইবার বুলিং-এর শিকার হয়েছেন। এবং এদের একটা বড় অংশই কম বয়সি শিশু-কিশোররা; যাদের জীবনে এর অনেক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, শিশুর অনলাইন আসক্তির পিছনে পিতা-মাতাকে আশি শতাংশ দায়ী বলা যায়। যেখানে মাতাকে শিশুদের প্রথম শিক্ষক বলা হয়, সেখানে অনলাইন হচ্ছে শিশুর পরিচালক। এখন আর মাতাকে প্রাথমিক শিক্ষক বলা যাবে না, অনলাইন বলাই যুক্তযুক্ত হবে। কেননা আধুনিক পিতা-মাতা ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে শিশুর খাবার খাওয়ানোর শর্টকাট পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। পাশাপাশি তাড়াতাড়ি ঘুম আসার জন্য একটু সময় না দিয়ে অনলাইন পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। কার্টুনসহ বিভিন্ন কন্টেন্ট দেখে দেখে ওই শিশু ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে শিশু অনলাইন বিনোদনের সীমা লঙ্ঘিত করে বিভিন্ন কন্টেন্টের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে খাবার ও ঘুমের প্রতি শিশুর অরুচি বেড়েই চলেছে। নতুন জিনিসের প্রতি তীব্র ইচ্ছা ও আগ্রহ সবারই থাকে। সীমাহীন কৌতূহল নিয়ে নতুন কিছু জানার আগ্রহে শিশু-কৈশোর ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। শিশুরা নতুন বন্ধু পেতে ভালোবাসে। বাইরের জগৎ থেকে ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুত্ব করা সহজ। তাই এরা খুব সহজেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরণ করছে। নিষ্পাপ শিশুদের এভাবে অনলাইন বিনোদনের দিকে নিজেরাই ঠেলে দিই অথচ ক্ষতিকর দিকটা আমরা লক্ষ্য রাখি না। রাতের অন্ধকারে মোবাইল ব্যবহারে দীর্ঘ অনিদ্রা দেখা যায়। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলা হয় ইনসোমিয়া। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার আর নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৪৫০। ইউভি রশ্মি আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না আর এসব রশ্মি মানব শরীরের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর। মোবাইলের বের হওয়া এসব রশ্মির কারণে যেসব রোগ হতে পারে- ড্রাইনেস অফ আই, আই স্ট্রেইন, ম্যাকুলার, ডিজেনারেশন, ক্যাটারেক্ট, ইনসোমনিয়া, ডিপ্রেশন, হেডেক, মাইগ্রেন। পড়াশোনা এবং খেলাধুলা করে এই বয়সে উৎফুলস্ন মনে থাকার কথা। সেটা না হয়ে বিপরীত হচ্ছে। প্রযুক্তির আকর্ষণে বয়ঃসন্ধি আগেই ঘটছে। পরিবর্তন হচ্ছে শরীরের এবং সেই সঙ্গে অনিরাপদ সম্পর্কে জড়িয়ে অল্প বয়সেই সুন্দর জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে কৈশোর সমাজ। তাছাড়া হারিয়ে যাচ্ছে মনোযোগ দিয়ে গল্প শোনার আনন্দ, পাশাপাশি বসে আড্ডা দেওয়ার মতো চমৎকার অনুভূতি, রাতের ঘুম, কাজের প্রতি গভীর মনোযোগ, মেধার বিকাশ হওয়ার ক্ষমতাসহ অনেক কিছু। আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করছে। জীবনযাত্রার এত পরিবর্তনের পিছনে একমাত্র ভার্চুয়াল জগৎ দায়ী। গবেষকরা ভার্চুয়াল আসক্তিকে বলছেন 'ভার্চুয়াল ভাইরাস'। ভ্যাকসিনবিহীন এই ভাইরাস নিরাময়ে সচেতনতাই একমাত্র উপায়। এই ব্যাপারে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। শিশুরা হচ্ছে সমাজের মধ্যমণি। জীবনের শুরুতে যদি এদের জীবনের অবকাঠামোকে দুর্বল করে দেওয়া হয় তাহলে জাতি বিশ্বের কাছে একদিন লজ্জিত হবে। সময় পেরিয়ে যায়নি। আমরা শিশুদের যেভাবে গড়ে তুলব এরা সেভাবেই বেড়ে উঠবে। জাতির কথা বিবেচনা করে প্রতিটি পরিবার সচেতন হলেই সাইবার ক্রাইম এবং জঙ্গির মতো বড় বড় অপরাধ থেকে কমলমণি শিশুরা রক্ষা পাবে। এরা দক্ষ নাগরিক হতে পারলে দেশ ও জাতির জন্য গৌরব বয়ে আনবে। \হ এস এম জসিম শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জ