প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত জনপদ

ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় সমাজের বিত্তবানদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করা জরুরি। তরুণ প্রজন্মকে মানবিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে ঘূর্ণিঝড়সহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আগ্রহী করে তোলা উচিত।

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০

খন্দকার আপন হোসাইন
মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের লেখা 'বড়র পিরিতি বালির বাঁধ' বাগধারাটি দিয়ে ভঙ্গুর বা মহা ঝামেলা বুঝানো হয়। চরণটিতে উলিস্নখিত একটি শব্দ বালি। এই বালির ওমান শব্দ রেমাল। ভয় ও আতঙ্কের আরেক নাম রেমাল। রেমাল মূলত বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম। যার আঘাতে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতে অন্তত ১৭ জনের মৃতু্য হয়েছে। ২০ মে, ২০২৪ বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণাবর্ত এলাকার সৃষ্টি হয়। ২২ মে সেটি লঘুচাপে রূপ নেয়। লঘুচাপটি ২৩ মে ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়। নিম্নচাপটি ২৫ মে সকালে আরও গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। ২৬ মে নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় রেমাল-এ রূপান্তরিত হয়। প্রাথমিকভাবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার মধ্য দিয়ে প্রবেশের কথা ছিল। কিন্তু সেটি একটু উত্তর দিকে বেঁকে সাতক্ষীরার ওপর দিয়ে উপকূলে প্রবেশ করে। ফলে ঝড়ের প্রধান অংশের আঘাত গিয়ে পড়েছে সুন্দরবনের ওপর। সেখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছে ১১১ কিলোমিটার। গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যানুসারে ঘূর্ণিঝড় রেমাল বাংলাদেশের উপকূলীয় ছয়টি জেলায় ১০ জনের মৃতু্য ঘটিয়েছে। ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত করেছে। দেশের ১৯টি জেলার ৩৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষ বরাবরই অসহায়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম একটি দুর্যোগ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। পুরনো ও ভীতিকর দুর্যোগ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে মোকাবিলা করে আসছে। প্রায় প্রতি বছরই তারা একাধিকবার ঘূর্ণিঝড়ের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এক সময় ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাতে মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যেত বহু উপকূলীয় তাজা প্রাণ। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেত তাদের স্বপ্নময় প্রিয় বাসস্থান। হারিয়ে যেত গবাদি পশু। শিকড় ওপড়ে ভূলণ্ঠিত হওয়া বৃক্ষরাজি ভেসে যেত সাগরতলে। গত তিন দশকে দেশবাসী বেশ কয়েকটি বড় বড় ঘূর্ণিঝড় দেখেছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঘাত করা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রলয়ংকর ছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাধারণত এপ্রিল-মে ও অক্টোবর-নভেম্বর মাসে উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ১৯৯০ সাল থেকে অদ্যাবধি ২৭টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। আঘাত হেনেছে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে। এর মধ্যে ১৫টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এলাকায় এবং বাকি ১২টি আঘাত হেনেছে সাতক্ষীরা থেকে ভোলা এলাকায়। প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে কম করে হলেও চারটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে দু'টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে আমাদের অংশে এবং বাকি দু'টি হয়ে থাকে আরব সাগর অংশে। বর্ষার আগে ও পরে বঙ্গোপসাগর এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। অনুকূল পরিবেশের অভাবে কোনো বছর ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি না হলেও নিম্নচাপের মাধ্যমে ঋতু প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বস্তুত ঘূর্ণিঝড় ও বঙ্গোপসাগর নাম দু'টি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর। ঘূর্ণিঝড় বিজলি, মোরা, রোয়ানু, মিধিলি, মোখা, আম্ফান, ফনি, সিত্রাং, বুলবুল এবং হালের রেমাল প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের বিশ্লেষণে এসেছে বিশ্বের ইতিহাসে প্রতি দশটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আটটি সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের ২০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় এসেছে বাংলা ভূখন্ডে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃতু্য হয়েছে কেবল ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে। ত্রিভুজাকৃতি বঙ্গোপসাগরের তীরে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত সমুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে হয়। বঙ্গোপসাগরের তীরে এযাবতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল ভোলা জেলায় ১৯৭০ সালে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৩৪ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে পস্নাবিত হয়েছিল উপকূলীয় অঞ্চল। প্রাণ হারিয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। এর আগে ১৭৩৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত বিস্তীর্ণ অঞ্চলসমূহে আঘাত হেনেছিল 'হুগলী নদীর ঝড়' নামক ঘূণিঝড়। যে ঝড়ে মৃতু্য হয়েছিল ৩ লাখ মানুষের। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হেনেছিল '০২ই' নামক ঘূর্ণিঝড়। যার প্রভাবে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে পস্নাবিত হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। প্রাণ হারিয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। ঘূর্ণিঝড় রেমালের শুরুতেই সুন্দরবনের অবস্থান। বাংলাদেশে আঘাতহানা প্রায় সব ঘূর্ণিঝড়ের মতো এবারও ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত বুকে আঁকড়ে ধরেছে সুন্দরবন। নিজে লন্ডভন্ড হয়ে উপকূলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের সঙ্গে বীরদর্পে লড়াই করে বাতাসের গতিবেগ হালকা করে দিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। ফলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের বাংলাদেশে প্রবেশের শুরুতেই বড়সড় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সুন্দরবন দেশের উপকূলকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে। সুন্দরী-গেওয়াসহ নানা বৃক্ষের মজবুত বেষ্টনী ও অসংখ্য নদীনালাসমৃদ্ধ সুন্দরবন আজীবন উপকূলের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছে। প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দরবন যে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলা করে থাকে। এরপরও ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে বিপন্ন হয়ে যায় উপকূলীয় মানব জীবন। তাই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নিম্নোক্ত নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। এক. উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের চরম সতর্কতা জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া। দুই. টাকা-পয়সা, জরুরি নথি, আধার, রেশন-প্যান কার্ডের মতো জরুরি জিনিস এবং অন্তত তিন দিনের জন্য শুকনো খাবার মোটা কোনো পস্নাস্টিকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া। তিন. বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে এসি, টিভি, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, গিজার, কম্পিউটারের পস্নাগ খুলে রাখা এবং যতটা সম্ভব বিদু্যৎ সংযোগের পরিষেবা কম ব্যবহার করা। চার. উড়ে গিয়ে কারও আঘাত লাগতে পারে এমন কোনো জিনিস বাড়ির ছাদে না রাখা। পাঁচ. বাড়িতে দুই-তিন দিনের জরুরি ওষুধ মজুত রাখা। ছয়. ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। আর অল্প সময়েই পানি জমে যায়। এই জমা পানিতে লুকিয়ে থাকতে পারে বিপদ। বিদু্যতের তার ছিঁড়ে পানিতে পড়লে ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই ঝড় থামামাত্র জমা পানিতে বের না হওয়া। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে আগাম ব্যবস্থা, সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষেত্রে আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বারবার ঘূর্ণিঝড় রেমালের সম্ভাবনা ও গতিবিধি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন হয়েছে। এ কারণে উপকূলীয় জনগণ পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই ঘূর্ণিঝড় রেমালের মোকাবিলা করেছে। একটি ভালো দিক হলো যে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পেলেই সরকার উপকূলীয় এলাকার মানুষের সুরক্ষায় ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু কেন যেন এখনো উপকূলীয় লোকজন ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস যথাযথভাবে আমলে নেয় না। আর এজন্যই হয়তো এবারও ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ১০-১২ জন মানুষের মৃত্যসংবাদ শুনতে হলো। বাঁচতে হলে উপকূলীয় এলাকার মানুষকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে এবং সচেতন করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে দুর্যোগব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিপিপি) উদ্বোধন করেছিলেন। সিপিবি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগের পরে কী করতে হবে সেই সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে আরও জোরদার করতে হবে। দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার অন্তত এক সপ্তাহ আগেই দেশের সর্বত্র সতর্কবার্তা পৌঁছানোর মতো শক্তিশালী অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। উপকূলীয় জেলা তো বটেই, বাংলাদেশের সব জেলাতেই আবহাওয়া গবেষণা সংগঠন স্থাপন করতে হবে। দুর্যোগব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশাবলি ১৯৯৭-এর আধুনিকায়ন করতে হবে। দুর্যোগপূর্ণ এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে সংশ্নিষ্টদের আরও সচেতন হতে হবে। মানুষকে ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য জানানো, সচেতন করা, আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা, গবাদি পশু সংরক্ষণ, ঘূর্ণিঝড়ের পরে মানুষের নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, ত্রাণ বিতরণ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করাসহ দুর্যোগকালীন নানাবিধ কাজে স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে এবং সে সব সংগঠনের কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ বা বন্ধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে পূর্বপ্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে অবৈধ বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের শিকার হয়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় সমাজের বিত্তবানদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করা জরুরি। তরুণ প্রজন্মকে মানবিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে ঘূর্ণিঝড়সহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আগ্রহী করে তোলা উচিত। খন্দকার আপন হোসাইন : শিক্ষক ও কলাম লেখক