সাবধান, চারদিকে প্রতারণার ফাঁদ

বর্তমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থা এমন যে, মানুষ খুব সহজেই একে অপরের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে। প্রতারণার মাত্রা এখন এতটাই প্রবল যে, এটা বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য। এর ফলে, মানুষ যেমন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে, একইভাবে ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে বৈষম্য ও অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
বর্তমান সমাজ স্বাভাবিকভাবে চলছে না। প্রতারক ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজ। যার ফলে সমাজের নিরীহ মানুষের মধ্যে স্বস্তি শান্তি নেই। তারা নানাভাবে প্রতারিত ও জিম্মি হচ্ছে খারাপ মানুষের দ্বারা। চারদিকে প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতা রয়েছে। একটু অসচেতন অসাবধান হলে যে কেউ ইচ্ছে করলে এ ফাঁদে পা দিতে পারে। ঘরে বসেই লাখপতি! না, শুধু লাখপতি হওয়ার যুগ শেষ, স্বপ্ন এখন কোটিপতি হওয়ার। অনলাইনে প্রতারণা হচ্ছে। কখন কোন সাইট প্রতারণা করবে, তা তো বোঝা যায় না। কেউ অভিযোগ করলে তখন খতিয়ে দেখে সরকারের পক্ষ থেকে সে সাইট বা লিংকগুলো বন্ধ করা হয়। এই প্রতারকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইনে, অ্যাপসের মাধ্যমে হাজারো উপায়ে জনগণকে ধোঁকা দেয়। দু'টি লিংক বন্ধ করলে এরা চারটি লিংক চালু করে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা এ ব্যাপারে বেশ সক্রিয়। কেবল অনলাইনেই নয়, সমিতি ও এনজিও খুলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র। ফলে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। একশ্রেণির দালাল বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামেও প্রতারণা করছে। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, ইরাক ও লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের বেশি পাচার করা হয়। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারকারীরা অন্তত ১৮টি রুট ব্যবহার করে। তারা বিভিন্ন দেশে বসে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। জানা গেছে, দালাল ও তাদের সহযোগীদের বিদেশে লোক পাঠানোর বৈধ লাইসেন্স নেই। প্রশাসনের নজরদারি ও স্থানীয় মানুষের সচেতনতার অভাবে দালালরা বিদেশে পাঠানোর নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ইউরোপের কোনো দেশে পাঠাতে একেকজনের কাছে থেকে নেওয়া হয় ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান টার্গেট এলাকার বেকার যুবক। টাকা নিয়ে প্রথমে তাদের ভ্রমণ ভিসায় দুবাই পাঠানো হয়। সেখানে দালাল চক্রের আরেক গ্রম্নপ তাদের দু'তিন দিন দুবাইয়ে রাখে। সেখান থেকে চার্টার্ড বিমানে পাঠানো হয় লিবিয়ায়। সুবিধামতো সময়ে দালালরা নৌকা বা ট্রলারে করে তাদের ইতালির উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে দুই-একজন ইতালিতে যেতে পারলেও বেশিরভাগই সাগরে নিখোঁজ হন বা মারা যান। কেউ কেউ বিদেশে নির্যাতনের শিকার হন। দালালরা মুক্তিপণ চেয়ে অভিভাবক আত্মীয়দের ফোন করে নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।' একুশ শতকের প্রতারণাপূর্ণ সমাজে বাস করলে তিনি কী বলতেন। হয়তো বা বলতেন, 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখা পাপ।' প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা নিজেদের এই অধঃপতনের জায়গায় কীভাবে নিয়ে এলাম। এটা একদিনে গড়ে ওঠেনি। কথায় বলে দুর্জনের ছলের অভাব নেই। পোশাকের বাহার, কথার বাহার, ক্ষমতা ও টাকার জাদু এবং নানারকম প্রলোভন সামনে এনে মানুষকে মোহগ্রস্ত করে ফেলে প্রতারকরা। এরা বিভিন্ন নামে ও পেশায় তাদের পরিচয় দেয়। প্রশাসন বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে, সমাজের প্রভাবশালী ও খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা এটাও প্রমাণ করতে চায় এবং মানুষকে বিশ্বাসও করায়। এরা এলাকায় দাতা ও জনদরদি হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত। এর শিকার হয় দেশের অসহায় মানুষ। প্রতারকদের পালস্নায় পড়ে এ দেশের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। প্রতারণা ঠেকানোর মূল হাতিয়ার জনগণের সচেতনতা। যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রতারণা ঘটতে পারে। প্রতারণা থেকে বাঁচতে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। এর আগে ই-কমার্স প্রতারণার বিষয়টি বেশ আলোচিত ছিল। বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়লেও আমাদের দেশে এ খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড নিয়ে চরম অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে দেশের ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ই-কমার্সকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে অনলাইনে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা চালু করেছে। এই সুবিধাকে পুঁঁজি করে দেশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এটা সবার জানা, পৃথিবীকে মুঠোর মধ্যে এনে দিয়েছে আমাজন, আলিবাবা, দারাজের মতো অনলাইন বাণিজ্যিক কোম্পানি। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই পণ্য যার যার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে প্রস্তুতকৃত যে কোনো পণ্য নির্ধারিত দামে অর্ডার করলে তা ঘরে বসেই পাওয়া যায়। জীবনকে গতিশীল করা কিংবা গতিশীল জীবনকে অধিকতর গতি দেওয়ার জন্যই ই-কমার্স। লাখ লাখ কর্মী এখন এই উপখাতটিতে কাজ করছেন, এক ধরনের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে- যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থা এমন যে, মানুষ খুব সহজেই একে অপরের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে। প্রতারণার মাত্রা এখন এতটাই প্রবল যে, এটা বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য। এর ফলে, মানুষ যেমন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে, একইভাবে ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে বৈষম্য ও অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তার বিরাট ভূমিকা থাকে। অবাক ব্যাপার, কেউ অফিস খুলে চাকরি দেওয়ার নামে, কেউ বিদেশে পাঠানোর নামে, কেউ অনলাইনে পণ্য কেনার নামে, কেউ বা হায় হায় কোম্পানি খুলে কোটি কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অবলীলায়। এদের প্রতিহত করতে হবে যে কোনো উপায়ে। না হলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। দ্রম্নত সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। এই প্রতারণার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের পরিকল্পিত ও কার্যকর উদ্যোগ। সালাম সালেহ উদদীন :কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক