জিয়াউর রহমান ও বিএনপি

বলতে দ্বিধা নেই বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের শূন্যতা আজও অপূরণীয়ই রয়ে গেছে।

প্রকাশ | ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০

জহির চৌধুরী
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আজ থেকে ৪৩ বছর আগে ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একদল সৈনিকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও দেশের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। প্রায় সাড়ে চার দশক আগে দল প্রতিষ্ঠাতার সেনা অভু্যত্থানে প্রাণহানি দলের জন্য ছিল বড় ধাক্কা। অনেকেরই ধারণা ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃতু্য তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির বিলোপ/বিলুপ্তি ঘটাবে। সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃতু্যর ৪৩ বছর পরও বিপুল জনসমর্থন নিয়ে রাজনীতিতে টিকে আছে বিএনপি। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকতে সক্ষম হলেও দলে জিয়াউর রহমানের শূন্যতা কি পূরণ হয়েছে সে প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। অস্বীকার করার জো নেই যে, বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের শূন্যতা তীব্রভাবে অনুভূত হওয়া অনেকটাই খোলামেলা। জিয়াউর রহমানের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, স্থানীয়, আঞ্চলিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন সক্ষমতার সমকক্ষ কাউকেই ৪৩ বছর ধরে বিএনপিতে দেখা যায়নি। বিএনপির রাজনীতিতে এখনো জিয়াউর রহমানই পাথেয়- এ বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় জিয়াউর রহমান কার্যত রাজনীতিবিদ না হয়েও রাজনীতিতে ঝানু/দক্ষ রাজনীতিবিদের ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক ব্যক্তিত্ব। সামরিক ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানকে রাজনীতিতে এনেছে পরিস্থিতি। রাজনীতিতে আসার পর সামরিক ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক সত্তার উন্মেষ ঘটেছে। নির্মোহ বিশ্লেষণ বলে ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ না হলেও স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা অভিজ্ঞ/দূরদর্শী রাজনীতিবিদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জ্ঞান-দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ক্ষেত্রবিশেষে ঝানু রাজনীতিবিদদেরও টপকিয়েছে। বিএনপি গঠন করে বিএনপির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে এসেছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন খুব বেশি দিনের ছিল না। কমবেশি চার বছর ধরা যায় জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বয়স। এত ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যেই জিয়াউর রহমান স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। দুনিয়ায় এ ধরনের নজির খুব একটা নেই। স্নায়ুযুদ্ধের ঔ যুগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রেখে কূটনীতিতে বিরল সাফল্য দেখিয়েছে। এর নেপথ্যের কারিগর ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের কৌশলী রাজনীতিতে পারদর্শিতা দৃশ্যমান বিষয়। সামরিক ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে এসে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিপুল সমর্থন পেয়েছেন, নবগঠিত বিএনপিকে শক্ত জনভিত্তি দিতেও সক্ষম হয়েছেন। সামরিক সমাজে জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করা জিয়াউর রহমান রাতারাতি গণমানুষের সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝার ক্ষমতা এবং পূরণে আন্তরিকতা জিয়াউর রহমানের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সুযোগ পেলেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছুটে যেতেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের হাল অবস্থা স্বচক্ষে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃতু্যর পর ১৯৮১ সালের ৩১ মে সংখ্যায় 'ওয়াশিংটন পোস্ট' লিখেছে, 'বাংলাদেশের নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মাসের বিশদিনই হেলিকপ্টারে চড়ে ঢাকার বাইরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন।' কানাডার সংবাদ মাধ্যম 'সিটিজেন অটোয়া' ২ জুন ১৯৮১ সংখ্যায় লিখেছে, 'নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জনগণের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন। মাসের প্রায় বিশদিনই হেলিকপ্টারে করে, ট্রেনে চড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চলে যেতেন। অল্পসময়ে অনেকগুলো গ্রাম দেখার জন্য তিনি মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেন।' প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজেই প্রমাণ করেছেন গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার গুণাবলি তার মধ্যে রয়েছে। দেশের মানুষের কাছে জিয়াউর রহমান কতটা প্রিয় ছিলেন তা তার জানাজায় আপামর মানুষের উপস্থিতির চিত্র বলে দেয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংসদ ভবন সম্মুখস্থ মানিক মিয়া এভিনিউর প্রশস্ত সড়কে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজার চিত্র তুলে ধরে লন্ডনের বহুল প্রচারিত পত্রিকা 'ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন' লিখেছে, 'অন্তত পক্ষে দশ লক্ষ লোক নতুন পার্লামেন্ট ভবনের সম্মুখে নির্মীয়মাণ সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউতে সমবেত হয়।' প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দলমত নির্বিশেষে গুণী/যোগ্যদের কদর দিতেন। এ গুণ তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কট্টর সমালোচক, বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের অন্ধ সমর্থক পরিচিত এমন অনেককেই জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন যোগ্যতা বিবেচনা করে। ভিন্নমত পোষণকারীদের অনেকেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদারতায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়ে দেশকে সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কেউ কেউ এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভক্তও হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার মানসিকতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন। দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জিয়াউর রহমান মাঝেমধ্যেই দলের পূরনো পল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের নেতাকর্মী, সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের ভিড় লেগে থাকত। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গাড়ি থেকে নেমেই হাত বাড়িয়ে দিতেন। বাড়ানো হাত এমন সব মানুষের শরীরও স্পর্শ করত যারা কোনো দিন ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেননি তাদের শরীরে দেশের প্রেসিডেন্টের হাতের ছোঁয়া লাগবে। আচমকা প্রেসিডেন্টের হাতের ছোঁয়ায় নেতাকর্মী, সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা বিমোহিত-পুলকিত/ধন্য হতেন। প্রেসিডেন্টের হাতের ছোঁয়ার কিচ্ছা বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছে বলে বেড়াতেন অনেকেই। বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, আঞ্চলিক/ বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি রিডিং সক্ষমতা, দেশের আপামর মানুষের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেশার, সুখ-দুঃখের সাথী হওয়ার, গুণীজন মূল্যায়নের সক্ষমতা জিয়াউর রহমানের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে প্রটোকলের বাইরে দেখা যেত না; জনসমাজে-সমাবেশে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে প্রটোকল ভেঙে বাইরে আসতে দেখা যেত। এ কারণে অনেক সময় তার নিরাপত্তায় নিয়োজিতরাও নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে হিমশিম খেত। বিএনপির পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্থান পূরণ আদতেই খুব সহজ নয়। 'ওয়াশিংটন পোস্ট' ১৯৮১ সালের ৩ জুন লিখেছে, 'রাষ্ট্রপতি জিয়া তার দেশে সর্বদিক থেকে একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতেন।' বিএনপি জিয়াউর রহমানের শূন্যতা পুরোপুরি পূরণে সক্ষম হয়তো হবে না। তবে জিয়াউর রহমানের নীতি আদর্শ অনুসরণ/লালন-ধারণ-চর্চা, জিয়াউর রহমানের রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে শূন্যতা বহুলাংশে পূরণ করতে পারে বিএনপি- এ সুযোগ বিএনপির আছে। বলতে দ্বিধা নেই বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের শূন্যতা আজও অপূরণীয়ই রয়ে গেছে। জহির চৌধুরী : কলাম লেখক