শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

বিপর্যস্ত উপকূল ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান

উপকূলীয় এলাকায় বিদু্যৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস এলেই বিদু্যৎ সঞ্চালন বন্ধ করে কোটি কোটি গ্রাহককে কয়েকদিন অন্ধকারে রাখা কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা নয়। আমরা মনে করি, অবিলম্বে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং বিদু্যৎ সংযোগ দ্রম্নততম সময়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে।
আর কে চৌধুরী
  ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০
বিপর্যস্ত উপকূল ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান

রোববার সন্ধ্যায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে প্রাণহানির সংখ্যা ১২ জন ছাড়িয়েছে। তবে এ ঘূর্ণিঝড় দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলায় যে তান্ডব চালিয়েছে তা গত আড়াই দশকের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ভয়াবহ। ঘূর্ণিঝড়পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, রেমালের আঘাতে উপকূলীয় জেলাগুলো তছনছ হয়েছে।

ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর জেলা। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭, ইউনিয়ন ও পৌরসভা ৯১৪টি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬। ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি। উপকূলীয় এলাকাগুলোয় ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। ওইসব আশ্রয় কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৮ লাখের বেশি লোক আশ্রয় নেন। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্যসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা।

বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ দেশের মানুষ অসহায়ভাবে মরেছে একের পর এক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কেউ দুর্গত এলাকার মানুষের দুর্দশা দেখার জন্য আসেনি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা যায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কোটিরও বেশি মানুষ। অনেকে গত রবিবারের ঘূর্ণিঝড়কে ১৯৯১ সালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ তুলনায় সারবত্তা থাকলেও গত তিন দশকে দেশের সর্বত্র দালান কোটা গড়ে ওঠা, বেড়িবাঁধ এবং আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধে অবদান রেখেছে। এ ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি এবং ফসল নষ্ট হওয়ার ঘটনা লাখ লাখ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। যা মোকাবিলায় কৃষি পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়াসহ সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াবে এমনটিই প্রত্যাশিত।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, কেবল খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও আংশিক, কোথাও পুরোপুরি ধসে গেছে। গাছপালা ও বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। ফসলি জমি নোনা পানিতে তলিয়ে গেছে।

হাজার হাজার মাছের ঘের ও পুকুর ডুবে গেছে। বিদু্যৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দ্বিতীয় দিনেও কয়েক লাখ মানুষ বিদু্যৎহীন অবস্থায় রয়েছে।

ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় পুরো উপকূলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরেও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

রাজধানী ঢাকারও অনেক রাস্তায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। রাজধানীতেও দুজন বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, একজন বিদু্যতের খুঁটি স্পর্শ করে, অন্যজন বিদু্যতায়িত টিনের বেড়ার সংস্পর্শে এসে মারা গেছে।

বাংলাদেশকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই এখানকার মানুষ টিকে আছে।

বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামনের দিনগুলোতে এসব দুর্যোগের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে তীব্রতা। এর প্রমাণও আমরা পাচ্ছি। ১৯৯১, ১৯৯৭, ২০০৭ ও ২০০৯ সালে বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। তারপরও প্রায় প্রতি বছরই এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এর মধ্যে আছে ঘূর্ণিঝড় মোরা, ফণী, বুলবুল, আম্ফান, ইয়াস, গুলাব, জোয়াদ, সিত্রাং ও সর্বশেষ রেমাল। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের এমন বাড়াবাড়ি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করেছিল উপকূল রক্ষা বাঁধগুলোকে আরো উঁচু ও মজবুত করে গড়ে তোলা, উঁচু ও বড় ঢিবি তৈরি করে গবাদি পশু রক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ব্যাপক সংখ্যায় আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য। কারণ দুর্যোগের সময়ও মানুষ গবাদি পশু ফেলে দূরের আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায় না। বাস্তবতা হলো, সাড়ে তিন বছর মেয়াদের 'মুজিব কিলস্না নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' প্রকল্পের কাজ সাত বছরে অর্ধেকও সম্পন্ন হয়নি। উপকূলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পগুলোরও প্রায় একই অবস্থা। কাজের মান নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। না হলে পাঁচ থেকে সাত ফুট জলোচ্ছ্বাসে এত বেশি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কীভাবে? বাঁধের সুরক্ষা কিংবা দেখভাল করা নিয়েও রয়েছে উদাসীনতার অনেক অভিযোগ। এই সুযোগে কিছু লোভী ও প্রভাবশালী মানুষ বাঁধের ক্ষতি করে জমিতে নোনা পানি ঢোকায় বাগদা চিংড়ি চাষ করার জন্য। এসব স্থানে বাঁধ দ্রম্নত ভেঙে যায়।

উপকূলীয় এলাকায় বিদু্যৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস এলেই বিদু্যৎ সঞ্চালন বন্ধ করে কোটি কোটি গ্রাহককে কয়েকদিন অন্ধকারে রাখা কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা নয়। আমরা মনে করি, অবিলম্বে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং বিদু্যৎ সংযোগ দ্রম্নততম সময়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে