শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব

কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করতে হবে- যাতে মানুষের কল্পনাশক্তি তার কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।
হিরা তালুকদার
  ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটি জাতি পারে তার সমাজ, দেশ তথা সারা বিশ্বের পরিবর্তন করতে। শিক্ষা ব্যতীত কোনো দেশ বা জাতির পরিবর্তন কখনো সম্ভব না। জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষা। আর শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভরশীল। কিন্তু দেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও শিক্ষাকে পরিকল্পিত গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে মানুষের উপযোগী করে তোলা যায় সে বিষয়টি তেমনভাবে ভাবা হয়নি।

যদি সে রকম গবেষণা হতো তবে মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন সেটি বের করা যেত। যখন আমরা মানবসম্পদের কথা বলি তখন জীবনসম্পৃক্ত শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন শিক্ষাকে জীবনসম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, তখন কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে কারিগরি শিক্ষায় প্রবেশের আগে জীবনাচরণগত শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই পরীক্ষা ছাড়া তাদের শিক্ষাপদ্ধতি গড়ে তুলেছে। এর ফলে, এসব দেশে শিক্ষার্থীদের মেধা যেমন বেড়েছে, তেমনি মানবিক প্রগতি অর্জনও সম্ভব হয়েছে।

কাজেই আমাদেরও শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল থেকে প্রবর্তিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে নতুনভাবে বাস্তবমুখী করে সাজাতে হবে। যদি প্রাথমিক স্তরে জীবনাচরণ সম্পৃক্ত শিক্ষা প্রবর্তন করা যায়, তবে যে উদার ও সৃজনশীল চিন্তা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে, তা তাকে পরবর্তী শিক্ষা স্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করবে।

পরবর্তী শিক্ষা স্তর কেমন হবে সেটি নির্ভর করবে রাষ্ট্রের মানবসম্পদকে কীভাবে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তার ওপর। এখানে শুধু কর্মসংস্থানের বিষয়ে ভাবলেই হবে না, বরং একজন শিক্ষার্থী যাতে তার অর্জিত শিক্ষা প্রয়োগ করে উদ্যোক্তা হতে পারে সে বিষয়েও ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এক সময় জনসংখ্যাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে পরিকল্পিত নীতির কারণে জনসংখ্যা আজ জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। তবে এ সম্পদকে কী করে যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা যায় সে বিষয়টি পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। যদি কারিগরি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানো হয়; তবেই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব হবে। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করেছে। এ লক্ষ্যে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য আগামী বছর অষ্টম শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষা চালু হতে যাচ্ছে। এ কারিগরি শিক্ষা চালু হলে তা শিক্ষার্থীরা ধারণ করে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা গবেষণা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে যে শিল্পকারখানাগুলো রয়েছে সেগুলোর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে কী ধরনের কারিগরি শিক্ষার প্রচলন করা হলে তা শিল্পে প্রয়োগযোগ্য হবে সেটা জানতে হবে।

এছাড়া বিশ্ববাজারে যে শিল্পকারখানাগুলো রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করে সে দেশগুলোতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করার পরিকল্পনাও শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের আগে ভাবতে হবে। আবার বিভিন্ন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকরা রয়েছেন তাদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্স আয়োজন করে কারিগরি শিক্ষার বাস্তব ধারণা শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবর্তন করতে হবে।

আবার কারিগরি শিক্ষা যেহেতু হাতে-কলমে নিতে হয়, তাই এ শিক্ষা প্রয়োগের আগে কারিগরি উপকরণগুলো যথেষ্ট পরিমাণ আছে কিনা সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ছাড়াও বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে ল্যাব গড়ে তোলার মনোভাব দেখাতে হবে।

এটি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও আসতে পারে। মনে রাখতে হবে, এটিকে কোনো দান নয় বরং কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সঙ্গে যারা এ কারিগরি শিক্ষা প্রদান করবেন, তারা হাতে-কলমে এ শিক্ষা প্রদানে সক্ষম কিনা সেই বিষয়টিও ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে যারা এ ধরনের শিক্ষাদান করবেন, তাদের এখন থেকেই বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

যদি অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করা হয় সেক্ষেত্রে আমাদের জিডিপির ১৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর। শিল্পায়নে এ হার ২৮ শতাংশ আর সার্ভিস সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে এটি ৫৬ শতাংশ। কৃষিনির্ভর কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে এর মাধ্যমে গবেষকদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ধারণার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।

এর ফলে, কৃষিক্ষেত্র হতে পারে কর্মমুখী শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে শিল্পায়নে জিডিপির হার হবে ৩৫ শতাংশ। তবে যদি কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ও প্রয়োগ যথাযথভাবে ঘটানো যায়, তবে তা এ হারকেও ছাড়িয়ে যাবে। একটি কথা বলা হয়, আমরা অর্থনীতিতে ৪৬তম, কিন্তু কারিগরি শিক্ষা ক্ষেত্রে ১১৪তম।

বিষয়টি নিয়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান সরকার অনেক বেশি কাজ করছে- যা আশাব্যঞ্জক। কারিগরি শিক্ষায় ইতিবাচক মনোভাব গড়ে না ওঠায় এক্ষেত্রেও শ্রেণিগত নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা কারিগরি শিক্ষাকে সেভাবে গ্রহণ করছে না। আর, এর ফলে, বেকারত্ব বাড়ছে ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪৭ শতাংশ।

অন্যদিকে, ২৫-৫৪ বছর বয়সের ৮২ শতাংশ মানুষ কর্মে নিয়োজিত থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৬.৩ শতাংশ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন, ৫৩ শতাংশ মাঝারি দক্ষ এবং ৪০.৭ শতাংশ অদক্ষ। অথচ উন্নত দেশে এ হার ২৫-৭৫ শতাংশ। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে ৫টি টাস্কফোর্স গঠন করেছে- যা হলো, পলিসি ও প্রজেক্ট ফর্মুলেশন টাস্কফোর্স, ইন্ডাস্ট্রি ও ইনস্টিটিউট লিংকেজ টাস্কফোর্স, টিভিইটি এনরোলমেন্ট টাস্কফোর্স, কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট টাস্কফোর্স এবং জব মার্কেট অ্যাসেসমেন্ট ও এমপস্নয়মেন্ট টাস্কফোর্স। যদি এ মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করা যায় তবে এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করতে হবে- যাতে মানুষের কল্পনাশক্তি তার কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।

\হএখানে প্রশ্ন হতে পারে, কেন কারিগরি শিক্ষায় চিন্তা ও কল্পনাশক্তির কথা বলা হচ্ছে? এর কারণ হলো কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে অনেক মানুষের একই ধরনের কারিগরি জ্ঞান গড়ে উঠবে, কিন্তু পার্থক্য থাকবে শুধু চিন্তা ও কল্পনাশক্তির ক্ষেত্রে। কাজেই কেবল হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে যন্ত্রচালিত রোবট বানালে চলবে না, বরং কীভাবে সে তার কারিগরি জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে চিন্তার বৈচিত্র্য ঘটাতে পারে সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই কারিগরি দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ এ ধরনের বিষয়গুলো কি থাকবে না? নাকি সময়ের পরিবর্তনে এগুলো যুগের চাহিদা হারিয়েছে? বিষয়টি এমন নয়। তবে আমাদের দেশে যে জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের এসব বিষয়ে জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানও থাকতে হবে। এর কারণ হলো, এ ধরনের বিষয়ে, বিশেষ করে আমাদের দেশে কাজের ক্ষেত্র কমে আসছে। কাজেই যারা এ বিষয়গুলো পড়ে আসছে, তাদের কাজের ক্ষেত্র কম থাকায় তারা যাতে বেকার হয়ে না থাকে সেজন্য এ বিষয়গুলোর সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এতে করে যেমন তাদের নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তেমনি তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। তার বিশেষায়িত জ্ঞান এক্ষেত্রে তাকে এগিয়ে নিতে পারে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের ১ শতাংশ লোক কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল। এখন তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সরকারের কারিগরি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এ হার ২০২০ সালে ২০ শতাংশ, ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে। উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম ভূমিকা রাখবে। আবার একইসঙ্গে নতুন নতুন শিল্প ধারণা সৃষ্টি করে সেই শিল্পে মানুষের দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে যুগোপযোগী করে এর বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব। আবার এর উৎকর্ষ, পরিবর্তন ও কারিগরি জ্ঞান থেকে অর্জিত ফলাফল যাচাইয়ের সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে সব পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।

হিরা তালুকদার : নবীন লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে