শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

আত্মহত্যা রোধে আমাদের ব্যর্থতা ও দায়বদ্ধতা

প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই বিরাজমান পরিস্থিতির নেপথ্যে সামাজিক প্রভাবকে এড়ানো যায় না। সমাজে নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবৈধ বৈষম্য ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক সারল্যে জটিলতা সৃষ্টি করে। ফলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দ্বান্দ্বিক জটিলতা মনো-সামাজিক বৈকল্যতা জন্ম দিতে পারে। আর এটা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে।
কাজী মাসুদুর রহমান
  ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০
আত্মহত্যা রোধে আমাদের ব্যর্থতা ও দায়বদ্ধতা

সমসাময়িক কালে আত্মহত্যা ও এর প্রবণতা আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে, তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়- যা গভীর উদ্বেগের। শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কাজ করে, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী বেসরকারি সংগঠন আঁচল-এর তথ্যমতে, বর্তমানে মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে স্কুল ও কলেজ স্তরে ৪৪৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে স্কুলের ৩৪০ জন ও কলেজের ১০৪ জন। তার মধ্যে ছাত্রী ২৮৫ জন ও ছাত্র ১৬১ জন। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন ৮৬ জন। অর্থাৎ, স্কুল ও উচ্চশিক্ষার স্তর সমেত আত্মহত্যাকারী নারী ৬৩.৯০% ও পুরুষ ৩৬.১%। এর মধ্যে পারিবারিক অভিমানে ২৭.৩৬% প্রেমঘটিত ২৩.৩২%, পারিবারিক কলহে ৩.১৪%, হতাশাগ্রস্ত ২.০১%, মানসিক রোগে ১.৭৯%, আর্থিক সমস্যাজনিত ১.৭৯% উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিতে ৩.১৩%। এছাড়াও, আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে শেয়ার করায় ৪ জন, শিক্ষক কর্তৃক অপমানে ৬ জন, গেম খেলতে বাধা দেওয়ায় ৭ জন, পরীক্ষায় অকৃতকার্যে ২৭ জন, মোবাইল ফোন না কিনে দেওয়ায় ১০ জন, মোটর সাইকেল না কিনে দেওয়ায় ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আবার ২০২৩ সালে উলিস্নখিত নানা কারণে স্কুল ও উচ্চতর শিক্ষাস্তরে মোট ৫১৩ জন আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যে ৬০.২% নারী ও ৩৯.৮% পুরুষ শিক্ষার্থী। এছাড়াও অন্যান্য নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথে হেঁটেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন আত্মহত্যা করছেন। এদের মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের সংখ্যাই বেশি। অতি সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষা '২০২৪-এর প্রকাশিত ফলাফল সন্তোষজনক না হওয়ায় সারাদেশে আটজন পরিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন- যা নজিরবিহীন এবং অত্যন্ত কষ্টদায়ক বটে। সারা বিশ্বে মোট আত্মহত্যার ৭৫%ই ঘটে মধ্যম ও নিম্নআয়ের দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থান দশমে।

আত্মহত্যার কারণ বিচিত্র হলেও মূলত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নানাবিধ সমস্যা থেকে সৃষ্ট ভারসাম্যহীন মানসিক পরিস্থিতি থেকে এ প্রবণতা সৃষ্টি হয়; আর, এ জাতীয় প্রবণতার অনিয়ন্ত্রিত অবনতিই আত্মহত্যা সংঘটনের পথে ধাবিত করে। যেহেতু এটি এখন ভয়ংকর মাত্রায় পৌঁছেছে সেহেতু পরিস্থিতি উত্তরণে ও উন্নয়নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও তা আলোচনার দাবি রাখে।

বলাবাহুল্য, পরিবার মানুষের জীবনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আশ্রয় ও আস্থার জায়গা। মানুষের মনোস্বাস্থ্য বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থান। এ ক্ষেত্রে মানুষের বয়ঃসন্ধিকাল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জৈবনিক স্তর। বয়ঃসন্ধি সময়ে (১৩-১৯) সাধারণত পরিবারই হয় ছেলেমেয়েদের সার্বিক আশ্রয় স্থল। যেহেতু আত্মহত্যা ও এর প্রবণতার ক্ষেত্রে এই বয়সের ছেলেমেয়েরাই এগিয়ে; সেহেতু পরিবারের এ ক্ষেত্রে অধিকতর দায়বদ্ধতা রয়ে গেছে। উলেস্নখ্য, একদা একান্নবর্তী পরিবারের প্রচলন ছিল। মানুষ পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে তারা সুখ-দুঃখ শেয়ার করত। তখন আর্থিক অনটনের মধ্যেও মানসিক শান্তি ছিল। সময়ের আবর্তে আধুনিকতার নামে সেই আবহমান ধারা এখন ভেঙে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিবারে পরিণত হয়ে তা আত্মকেন্দ্রিকতায় বন্দি হয়ে গেছে। এখন তা কেবলই রূপকথার কল্পকথা মাত্র। মানুষের প্রত্যাশা ও চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনও অধিকতর চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা দু'জনই বাইরে কর্মব্যস্ত থাকেন। এমতাবস্থায় শিশুকে তার পিতামাতার সান্নিধ্য ছাড়াই শৈশব-কৈশোর পার হতে হয়। পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের কাছ থেকেও শিশুসহ বয়ঃসন্ধি ছেলেমেয়েদের যতটুকু মানসিক সাহচার্য প্রয়োজন তা তারা পায় না। ফলে সৃষ্ট একাকিত্ব তাদের বিষণ্নতায় নিমগ্ন করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রেম, স্নেহ, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি প্রভৃতি মানুষের সহজাত প্রত্যাশিত চাহিদা- যার মূল উৎস পরিবার। পরিবারকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কেননা, পারিবারিক শূন্যতার বিকল্প অন্য কিছুতে পরিপূরণ হয় না।

প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই বিরাজমান পরিস্থিতির নেপথ্যে সামাজিক প্রভাবকে এড়ানো যায় না। সমাজে নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবৈধ বৈষম্য ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক সারল্যে জটিলতা সৃষ্টি করে। ফলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দ্বান্দ্বিক জটিলতা মনো-সামাজিক বৈকল্যতা জন্ম দিতে পারে। আর এটা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে।

যেমন, প্রায়ই দেখা যায় মোটর সাইকেল বা স্মার্টফোন কিনে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যা করছে। তার সমবয়সি অন্যরা ওটা ব্যবহার করছে। তাই ওটা প্রাপ্তির জন্য তার মধ্যে একটা স্বপ্নীল আবেগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু অপ্রাপ্তির হতাশা থেকে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বয়ঃসন্ধি কিশোর-কিশোরীর মধ্যে এ জাতীয় মনোবৃত্তি পরিলক্ষিত হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান সমাজে সামাজিক সৌজন্যতাবোধ এখন বহুলাংশে লোপ পেয়েছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতামূলক প্রতিবেশীসুলভ আচরণ এখন অনেকটাই লুপ্ত। আমাদের মনে রাখা উচিত, সমাজে মানবিক অবক্ষয় ঘটলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবাকেই ভোগ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকার তাদের দায় এড়াতে পারে না। কেননা, উদ্ভূত পরিস্থিতি উত্তরণে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের নির্লিপ্ততা হতাশাজনক। বিশেষ করে এ সংকট রোধে পরিবার কল্যাণ ও সমাজসেবা বিষয়ক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে কার্যকর কোনো গণমুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এমনকি শিক্ষা বিভাগের উদাসীনতাও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট লক্ষণীয়, যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর খুবই স্পর্শকাতর। কেননা, এই দুই স্তরে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে। অথচ তাদের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তিত পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের তাৎপর্য সাপেক্ষ জীবনবোধী কোনো পাঠ প্রণয়ন বা সংযোজন করা হয়নি। এমনকি শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের জীবনধর্মী মোটিভেশনাল শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, অধিকাংশেরও বেশি শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা বা জ্ঞান রাখেন না। এছাড়া, এতদ্বিষয়ে তাদের কোনো বিশেষায়িত দীক্ষা বা প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের মনোবিকাশ সৃষ্টির লক্ষ্যে খেলাধুলা ও শিল্পসংস্কৃতির চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সহ-পাঠশিক্ষা কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে হবে। বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে আরও গবেষণা করতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে গণমাধ্যমেরও যথেষ্ট দায়বদ্ধতা রয়েছে। গণসচেতনতা সৃষ্টিতে তাদেরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিল্পী ও কলাকুশলীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। কেননা, জগতের কোনো ধর্মই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। এ লক্ষ্যে ধর্মবিষয়ক বিভাগকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তৃণমূল স্তরে স্ব স্ব ধর্ম-দর্শনের আলোকে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। উপরন্তু, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে এটি ক্রমশ সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে মোর নিচ্ছে। তাই এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা সমীচীন বলে মনে করি। মনে রাখতে হবে, যিনি যে কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন তিনি প্রকারান্তরে একই কারণের শিকার অবগত অন্যের জন্যও পথ তৈরি করে গেলেন। কেননা, এটা অনেকটা মনো-সংক্রামক ব্যাধি।

যদি উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যায় তবে প্রতিটি জীবনই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে বৈকি। সেই দৃষ্টিতে প্রতিটি জীবনই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ। তাই আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিরসনে সামগ্রিক তথা বৃহত্তর স্বার্থে প্রত্যেকেরই স্ব স্ব অবস্থানে থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা উচিত।

কাজী মাসুদুর রহমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে