শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

দূষণে শোষণে পস্নাস্টিকের ভূমিকা

পরিবেশকে পস্নাস্টিকের হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে সর্বপ্রথম পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। কিন্ুত্ম অবস্থা এখন এমন যে পলিথিন ব্যাগ ও পস্নাস্টিক পণ্যের জয়জয়কার।
মো. তবিউর রহমান
  ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০
দূষণে শোষণে পস্নাস্টিকের ভূমিকা

পস্নাস্টিকের বাংলা কি? এমন প্রশ্নে হয়তো কেউ বিরক্ত হচ্ছেন আবার মুচকি হেসে কেউ হয়তো ভাবা শুরু করে দিয়েছেন যে, তাই তো! পস্নাস্টিককে এক কথায় আসলে কি নামে ডাকা হয় বাংলায়! ডিজিটাল ডিকশনারি খুলে দেখার চিন্তা-ভাবনাও হয়তো কেউ কেউ করছেন। সে যাই হোক, বাংলায় আগত এ বস্তুটিকে ডাকার মতো তেমন কোনো নাম আসলে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই যে নামে এসেছে সে নামেই রয়ে গেছে এ বাংলায়। তবে ভেবে অবাক হতে হয় যে, বাংলাতে যার তেমন কোনো নামই নেই, বাংলাদেশের চারদিকে তার কেন এত ছড়াছড়ি! যেখানে-সেখানে দখলে দূষণে এমন এক অবস্থা যেন পস্নাস্টিকেরই রাজত্ব যদিও তার আগমন এদেশে খুব বেশি পুরনো নয়। নামে-বেনামে এ রকম যখন যারা আগমন করেছে এ অঞ্চলে তারা কেউ কেউ শোষণ করেছে আর কেউ কেউ দূষণ করেছে। গভীরভাবে দেখলে অবশ্য দেখা যায়, যে শোষণ করেছে সে দূষণও করেছে আবার যে দূষণ করেছে সে শোষণও করেছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে শোষণ-দূষণের অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে দূষণ-শোষণের তালিকা করলে বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিষয়টি আলোচনায় আসে সবার আগে তা হচ্ছে এই পস্নাস্টিক। পস্নাস্টিকের প্রভাবে দেশের পরিবেশ কিভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দিনদিন শোষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে এই পস্নাস্টিক মূলত তা নিয়ে আলোকপাত করাই আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।

শোষণ-দূষণ ও দূষণ-শোষণ যেন এদেশের ভাগ্যে লেখা এক মহাকাব্য। শুরু থেকেই যেসব বিদেশী বাংলার এ অঞ্চলকে শাসন করেছে তারা শুষে নিয়ে অর্থ-সম্পদ দিয়ে গেছে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন সময় এ অঞ্চলকে যারা শাসনের নামে শোষণ করেছে তারা যে শুধু সম্পদই লুটে নিয়েছে তা নয় বরং শোষণের পাশাপাশি মানুষের বংশ মর্যাদা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, আইন-আদালত সবকিছুকে এমনভাবে দূষিত করেছে তার ক্ষত আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। তারা যে দূষণ করেছে তার প্রমাণ যেমন আমাদের চেহারার মধ্যে (সংমিশ্রণ) দেখা যায় তেমনি আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচারণ ও অভ্যাস সবকিছুতেই মৌলিকত্বের অনেক অভাব লক্ষ্য করা যায় এখনো। মৌলিক ধারণার অভাব থেকেই আমরা অনেক সময় এমন এমন কাজ করে বসি যার নেতিবাচক প্রভাব যে কতটা গভীর তা গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় আসলে আমরা নিজেরা নিজেদের প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে যাচ্ছি। যেমন- নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান এই দেশে পস্নাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও সে বিষয়ে আমাদের উদাসীনতাই বড় প্রমাণ। পস্নাস্টিকের প্রভাবে পরিবেশ দূষণ নিয়ে ওপরে ওপরে হয়তো কিছুটা আলোচনা-সমালোচনা হয় কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে পস্নাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পস্নাস্টিক যে শুধু পরিবেশ দূষণ করছে তা নয় বরং দূষণের পাশাপাশি এদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে শোষণ করছে তা আজ স্পষ্টভাবে না বুঝলেও বুঝতে হয়তো আরও বেশি সময় লাগবে না যে, এই পস্নাস্টিকই হবে পরনির্ভরশীলতার অন্যতম কারণ। আর পরনির্ভরশীল যারা তারা শোষণযন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকবে তা ভাবা এক কথায় অর্থহীন।

পস্নাস্টিককে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের যেখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে সেখানে আমি পরনির্ভশীলতার ভয় দেখাচ্ছি বলে যারা মনে করছেন তারা কোনো যুক্তি দাঁড় করাবেন দেশীয় প্রযুক্তির ও স্বাস্থ্যসম্মত কোনো পণ্যের বিপরীতে অস্বাস্থ্যকর ও পরিবেশ বিধ্বংসী এই পস্নাস্টিকের অবস্থানকে? ব্যবহারের ক্ষেত্রে উপযুক্ততা ছাড়া সস্তা ও সহজলভ্যতা কোনো কিছুর গ্রহণযোগ্যতার মানদন্ড হতে পারে না। কিন্তু আমরা উপযুক্ততার চাইতে সস্তা ও সহজলভ্যতাকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে ক্ষতি করছি চরমভাবে। পস্নাস্টিকের কারণে মৃৎশিল্প আজ মৃত প্রায়। বলতে গেলে মরেই গেছে আর সেই সঙ্গে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে বড় বড় ডোবা/খানা গর্ত পুকুর ইত্যাদি যেখান থেকে কুমাররা মাটি এনে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করত। জলাধার হিসেবে এসব ডোবাখানা গর্ত পুকুরে প্রাকৃতিক মাছসহ একটি পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পেত। দেশের মাটি দিয়ে দেশীয় তৈজসপত্রের মতো দেশের গাছ, বাঁশ, বেত, হোগলা পাতা ইত্যাদির ছিল ব্যাপক ব্যবহার যার বড় একটা অংশ এখন পস্নাস্টিকের দখলে। যুক্তি দেখিয়ে কেউ কেউ হয়তো বলবেন পস্নাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে বৃক্ষ নিধন কমেছে। এটা যদি যুক্তি হয় তবে এ যুক্তিতেই বলা যায় যে, পস্নাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণেই দেশে গাছের সংখ্যা কমেছে। যেসব পণ্য দেশের গাছ, বাঁশ, বেত ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হতো সেসব পণ্যের বিকল্প হিসেবে সস্তায় পস্নাস্টিক পণ্য পাওয়াতে দেশের গাছ, বাঁশ, বেত ইত্যাদির চাহিদা কমে যাওয়ায় এগুলো লাগানোর চাহিদাও কমে গেছে। কারণ মানুষ যা থেকে লাভ পায় তার দিকে ঝোঁকে বেশি। গাছজাতীয় পণ্যের চাহিদা কম মানে গাছের দাম কম, লাভ কম, গাছ রোপণের হারও কম।

অন্যদিকে যত্রতত্র পস্নাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন আবর্জনার কারণে গাছের অনেক বীজের অঙ্কুরোদগম না হওয়া, অঙ্কুরিত চারা গাছের শিকড় মাটির গভীরে যেতে না পারা ও মাটি থেকে পর্যাপ্ত খাদ্যপানীয় না পাওয়ায় গাছ মারা যাচ্ছে এবং কমে যাচ্ছে গাছের সংখ্যা। পস্নাস্টিকের কারণে বৃষ্টির পানির স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়া ও ময়লামিশ্রিত পস্নাস্টিক সামগ্রী জলাধারের তলদেশে জমা হওয়ায় পানির শোষণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অস্বাভাবিক বন্যা বা জলাবদ্ধতার কারণে মারা যাচ্ছে গাছ ও ক্ষেতের ফসল অর্থসম্পদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কৃষিপ্রধান এ দেশের অর্থকরী ফসল পাট থেকে যে সুতা, চট, বস্তা, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি হতো তা আজ পস্নাস্টিক জাতীয় পণ্য বিশেষ করে পলিথিনের দখলে। ফলে পাটের পহিদা ও মূল্য কমে যাওয়ায় কৃষক পাট চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। পানিতে গলে না, মাটিতে পচে না এবং গাছের শিকড় যা ভেদ করতে পারে না তা পরিবেশের জন্য যে মারাত্মক ক্ষতিকর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যক্ষভাবে সস্তা ও সহজলভ্য হলেও পরোক্ষভাবে এই যে দেশের পরিবেশের ক্ষতি, দেশীয় পণ্যের ও প্রযুক্তির ক্ষতি, আত্ম-কর্মসংস্থানের ক্ষতি অর্থাৎ দেশের ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প এবং পাট পণ্যের বৃহৎ শিল্প ক্ষতি করে বাইরের দেশের কাঁচামাল, মেশিন ও প্রযুক্তি আমদানির নির্ভরতা কি পরনির্ভরশীলতা নয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি, বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা অজুহাতের বিভিন্ন শর্তে আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ শুষে নেবে আর আমরা আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি ফেলে, নিজেস্ব প্রযুক্তি ভুলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষতির সাক্ষী হতে থাকব। তাই সময় থাকতে হুঁশিয়ার হতে হবে নয়তো পরে বোঝা যাবে সহজলভ্যতা ও সস্তার কি দুরবস্থা!

পরিবেশকে পস্নাস্টিকের হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে সর্বপ্রথম পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। কিন্ুত্ম অবস্থা এখন এমন যে পলিথিন ব্যাগ ও পস্নাস্টিক পণ্যের জয়জয়কার।

আমাদের নিজেদের ঘরের মধ্যে যদি দেখি তবে খুব সহজেই চোখে পড়বে যে অন্য যে কোনো বস্তুর তুলনায় পস্নাস্টিক পণ্যই মনে হয় সবচেয়ে বেশি। আর বয়োজ্যেষ্ঠদের জিজ্ঞাসা করলে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবে যে, দেশি কোনো কোনো পণ্যের জায়গায় পস্নাস্টিক পণ্য জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে আবার আমাদের দেশের কিছু মানুষের ওয়ান টাইম নামে পস্নাস্টিক জাতীয় পণ্যের অবাধ ব্যবহার যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা। পাট জাতীয় সুতার ব্যাগ, কাপড়, কাগজ, কাচ, টিন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ব্যবহার উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও পস্নাস্টিক জাতীয় বস্তু দিয়ে তৈরি ব্যাগ, বোতল, কৌটা, প্যাকেট ইত্যাদি ব্যবহার করে যেসব কোম্পানি তারা সবচেয়ে বেশি দায়ী এই দুরবস্থার জন্য। ইদানীং বিস্কুটের প্যাকেটের মধ্যে পস্নাস্টিকের অতিরিক্ত কেস দেখা যায় এবং সাবানসহ বিভিন্ন পণ্যের পা্যাকেটের মধ্যে অতিরিক্ত পলিথিন দেখা যায়। বিভিন্ন পণ্যের ওপর অযথা পস্নাস্টিকের মোড়ক দেখা যায়। এই অতিরিক্ত খরচ সরাসরি ক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে অথবা পণ্যের গুণগতমান খারাপ দিয়ে তা পোষানো হচ্ছে। আর এই দুর্বল প্রকৃতির পণ্য সহজে নষ্টের হাত থেকে বাঁচাতেই হয়তো অতিরিক্ত পস্নাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। তা না হলে সমজাতীয় পণ্যে কিছু কোম্পানি যেমন কসকো সাবান ও জেট ডিটারজেন্ট পাউডার, জুঁই নারিকেল তেল, বিডি সস ইত্যাদি যথাক্রমে এখনো কাগজের প্যাকেট, টিনের কৌটা কাচের বোতল ইত্যাদি যদি ব্যবহার করতে পারে। তবে অন্যরা যারা পস্নাস্টিক ব্যবহার করে, কেন? এটা অবশ্যই প্রতিরোধ করা উচিত। এই প্রতিরোধে আমরা ক্রেতারা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারি আর তা হলো যেসব কোম্পানি তাদের পণ্যে অযথা বা অতিরিক্ত পস্নাস্টিক ব্যহার করে তাদের পণ্য ক্রয় করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা এবং পস্নাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা। আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান থেকে আমরা যদি সচেতন না হই তবে যে পস্নাস্টিককে আমরা সহজে মেনে নিচ্ছি সেই পস্নাস্টিকই এক সময় অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।

মো. তবিউর রহমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে