শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষাক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন

প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র মেধাবী, নৈতিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শুদ্ধ করতে হবে। এ জন্য একটি সঠিক, যুগোপযোগী কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করার প্রয়োজন আগে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ২২ মে ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষাক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন

একটি গল্প দিয়েই শুরু করি।

একদিন বাবা ও ছেলে তাদের পোষা গাধাটিকে বিক্রি করার জন্য হাটে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর একজন লোক তাদের দেখে বলল, 'লোক দুটি কী বোকা। গাধা থাকতে তারা হেঁটে যাচ্ছে।' এই কথা শুনে বাবা ছেলেকে গাধার পিঠে উঠিয়ে নিজে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর একজন পথিক বলল, 'কি বেয়াদব ছেলে! নিজে আরাম করে গাধার পিঠে বসে যাচ্ছে, আর বুড়ো বাবাকে হেঁটে যেতে দিচ্ছে।' এরপর বাবা গাধার পিঠে উঠল; ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে এক মহিলা বলল, 'কেমন বাবা! নিজে গাধার পিঠে উঠে ছেলেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।' এই মন্তব্য শুনে বাবা ও ছেলে দুজনেই গাধার পিঠে উঠল। একজন পশুপ্রেমিক এই দৃশ্য দেখে বলল, 'কি অত্যাচার! দুজন লোক একটি গাধার পিঠে!'

এবার বাবা-ছেলে পড়ল মহাবিপদে। তারা গাধার চার পা রশি দিয়ে বেঁধে; রশির ভিতর বাঁশ দিয়ে, বাঁশের দুই মাথা দুজন কাঁধে বহন করে গাধাকে নিয়ে চলল। হাটের কাছে এসে পুল পার হওয়ার সময় গাধা ভয় পেয়ে নড়েচড়ে উঠে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করল। ফলে বাবা, ছেলে ও গাধা তিনজনই ধপাস করে পানিতে পড়ে গেল।

গাধার ভাঙল মেরুদন্ড, বাবা-ছেলের ভাঙল পা।

শিক্ষা : এই গল্পের শিক্ষা হলো, লোকের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। চলমান দাবদাহে জ্বলছে সারাদেশ। এরকম উত্তপ্ত পৃথিবী একজন্মে এদেশে মানুষ ইতিপূর্বে দেখেনি। তবে গ্রীষ্মকাল উত্তপ্ত থাকে এটা সবার জানা। এবার শীতকালও ছিল তুলনামূলকভাবে অতি শীতল। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের অভ্যাস এবং জীবনযাত্রা।

তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষাঙ্গনে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত মিলছে না। সচিব, শিক্ষামন্ত্রী, হাইকোর্ট কারো সঙ্গে কারো সিদ্ধান্ত মিলছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসছে নানা মত। যার যার অবস্থান থেকে সেই মতামত দিচ্ছে। উত্তাপের পরিমাণ বাংলাদেশের সব জেলায় সমান নয়। ঢাকার আইডিয়াল, ভিকারুননিসা বা সেন্ট জোসেফ আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সবার এক চিত্র নয়। রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিক্ষুকসহ অতি নিম্ন্ন আয়ের অভিভাবকের সন্তানরা আসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হাতেগোনা কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী বাদে এদের মা-বাবা দুজনই থাকেন কর্মক্ষেত্রে। স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস করা এদের জন্য সম্ভব নয়। তাছাড়া কারো কারো বাসায় কারেন্ট থাকে না সবসময়। এদের বাড়িতে না গেলে ভাবা যাবে না একই বাড়িতে ২০-২৫টা পরিবার কেমন করে থাকে। বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ অন্যরকম। অন্যদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া অন্য যেসব বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করছে, সেখানে মা-বাবা সচেতন।

করোনাকালে সচেতন অভিভাবকের সন্তান, নামিদামি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুল ড্রেস পরে, টিফিনবক্স সামনে নিয়ে টেবিলে বসে অনলাইন ক্লাস করেছে। কিন্তু নিম্ন্নবিত্তের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে আনাই সম্ভব হয়নি। সুতরাং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট ছোট শিশুদের জন্য অনলাইন ক্লাস কার্যকর নয়।

শিশুদের লালনপালনের জন্য মায়ের স্বশরীরে উপস্থিতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন শিশুদের শিক্ষার জন্যও শিক্ষকের স্বশরীরে উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। দাবদাহ শেষ হলেই শুরু হবে অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও বন্যা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের সমস্যা বর্ষাকালে বিভিন্নরকম হয়ে দেখা দেবে। ঢাকা শহরে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা শুরু হয়। এ সময় রাজধানীতে শুরু হয় ডেঙ্গুর প্রকোপসহ নানা ধরনের অসুখ। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। আবার দেশের নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিক্ষাক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কিন্ডারগার্টেন মানে না। এই সময়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

নতুন শিক্ষাক্রম, জলবায়ুজনিত নানা ধরনের সমস্যা, ছুটি নিয়ে একেক সময়ে একেক ধরনের সিদ্ধান্ত- এসব নানা কারণে বিভ্রান্ত অভিভাবক এবং শিক্ষক। একটা দেশ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও শিক্ষা নিয়ে এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। একটি সার্বজনীন স্থায়ী সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারার লজ্জা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এ সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য কিন্তু কিন্ডারগার্টেনসহ অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো ক্লাস টেস্ট নাম দিয়ে ঠিকই পরীক্ষা নিচ্ছে। মোটা অঙ্কের পরীক্ষা ফি নিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পরীক্ষা নিচ্ছে কতিপয় কিন্ডারগার্টেন গোপনে।

পরীক্ষা না হওয়া, বারবার স্কুল বন্ধ হওয়া, শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত থাকা বিভিন্ন কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি প্রতিনিয়ত কমছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি দিয়েও উপস্থিতি বাড়ানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে সুফল পাচ্ছে কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা। একটি দেশে প্রাথমিক স্তরে এত ধরনের শিক্ষা আছে কি না আমার জানা নেই। ফিনল্যান্ডের উন্নত শিক্ষাক্রম আমদানি করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা হলো কিন্তু ফিনল্যান্ডের শিক্ষকের বেতন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা এসব উপেক্ষা করে ঝাড়ুদারের সমতুল্য বেতনের শিক্ষক, যাদের সারা জীবনেও কোনো পদোন্নতি নেই তাদের হাতেই তুলে দেওয়া হলো ফিনল্যান্ডের শিক্ষাকে। তাজমহল তৈরির সময় যমুনা নদীর ঢেউ বিবেচনায় রেখেছিলেন তৎকালীন কারিগররা। অথচ একটা ছুটির তালিকা বর্তমানের জ্ঞানী নীতিনির্ধারকরা তৈরিতে ব্যর্থ। আমাদের সভ্যতা আর শিক্ষার নমুনা এই। এরা বৃষ্টি না এলে বুঝেন না বন্যার ভয়াবহতা। গ্রীষ্মকাল না আসা পর্যন্ত বুঝতে পারেন না দাবদাহ কী? তিন ঘণ্টা-চার ঘণ্টা বিদু্যৎ না থাকলে কী সমস্যা হয় সেটাও তারা বুঝতে পারেন না। সঠিক পরিকল্পনা তৈরির অভাব শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবল। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট সবই এবার দেখেছে এদেশের শিক্ষক, অভিভাবক সবাই। সুতরাং দয়া করে, আগামীতে অন্তত ছুটির তালিকা তৈরির সময় এদেশ, দেশের জলবায়ু, ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার সামাজিক অবস্থা সব বিবেচনায় নিয়ে মেধা খরচ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে হ-য-ব-র-ল তত প্রকট হচ্ছে। সমস্যা থাকলে তার সমাধানও থাকে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে উন্নয়ন ঘটছে অবকাঠামোর, শিক্ষার নয়। অন্তঃসারশূন্যে পরিণত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। কোচিং ফুলেফেঁপে উঠছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানা কৌশলে তাদের মতো চলছে। আর দিন দিন ভিতরে ভিতরে অন্তঃসারশূন্য হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা। প্রতি বছর নতুন নতুন কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টারে ছেয়ে যাচ্ছে অলিগলি। নীতিমালা ছাড়াই তৈরি হচ্ছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারের এ ব্যাপারে ভাবতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলো কী, তা নির্ধারণের ক্ষমতা প্রাথমিক শিক্ষকদেরই শুধু আছে। এসি রুমে বসে দাবদাহ সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যা চিহ্নিতকরণের জন্য মেধাবী শিক্ষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতি বছর ধরে ধরে এসব সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে। উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাটের মতো শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের চমক না দেখিয়ে সত্যিকারের শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা জরুরি। সেই পরিকল্পনায় শিক্ষকদের মতামত এবং পরামর্শ গ্রহণ করাও জরুরি।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষা এনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সব ব্যর্থতার দায় শিক্ষকদের ওপর না চাপিয়ে, ফিনল্যান্ডের শিক্ষকের জীবনমানও নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের মেধার পাশাপাশি তাদের নৈতিকতাকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। নির্বাচনের মতো মহান কাজে শিক্ষকদের ব্যবহার না করে শুধু শিক্ষার কাজে তাদের মনোযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষকের নৈতিকতা রক্ষার মনোভাব রাষ্ট্রের থাকতে হবে। অনৈতিক শিক্ষক দিয়ে নৈতিক জাতি গঠন সম্ভব নয়। প্রায়ই শিক্ষকের যৌন নির্যাতন, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিসহ নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডের কথা শোনা যায়। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তাহলে সে মেরুদন্ড গড়ার কারিগর শিক্ষক। সুতরাং শিক্ষকের মেরুদন্ডটি শক্ত থাকতে হবে আগে।

প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র মেধাবী, নৈতিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শুদ্ধ করতে হবে। এ জন্য একটি সঠিক, যুগোপযোগী কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করার প্রয়োজন আগে।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি কথাসাহিত্যিক শিক্ষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে