মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১
পাঠক মত

মারণঘাতী থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ

সুমাইয়া আকতার সরকারি ব্রজমোহন কলেজ বরিশাল
  ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
মারণঘাতী থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ

মারণরোগ থ্যালাসেমিয়া। ক্যানসারের মতো নীরবঘাতক একটি জন্মগত জিনগত রোগ। দেশে শতকরা ৮-১০ ভাগ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক; কিন্তু বেশিরভাগই এ বিষয়ে অজ্ঞ। যে কারণে বেশিরভাগ রোগীই থ্যালাসেমিয়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও এর লক্ষণ না জানার কারণে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।

যেটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি গুরুতর সমস্যা। সঠিক সময়ে প্রতিরোধযোগ্য এ রোগটি ত্রম্নটিপূর্ণ জিনের কারণে হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত হলে শরীরে লোহিত রক্ত কণিকার বয়স ২০ দিন কমে যায়। সাধারণ শরীরে লোহিত রক্তকণিকা ১২০ দিন টিকে থাকে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগে ১০০ দিনেই লোহিত রক্ত কণিকার আয়ু শেষ হয়। এতে হিমোগেস্নাবিনের উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফলে রোগীর দেহে মারাত্মক রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়ার জিন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।

গ্রিক শব্দ 'থ্যালাসেমিয়া' কথাটির অর্থ রক্তের সমুদ্র। এ রোগের শুরুটা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায়। এসব অঞ্চলে মহামারি আকারে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের মধ্যে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে হিমোগেস্নাবিন উৎপাদনের জিনে ত্রম্নটির সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকার হিসেবে এ জিনগত ত্রম্নটি প্রজন্মের পর প্রজন্মে অনুপ্রবেশ করেছে। ক্রমান্বয়ে বিশ্বায়ন, মাইগ্রেশন ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে এটি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। যেহেতু থ্যালাসেমিয়া রোগটি বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ এই রোগটা আসে মা ও বাবার জিন থেকে। যখন স্বামী ও স্ত্রী দুজনই বাহক হয় তখন তাদের প্রতিটা সন্তানের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। আর যদি একজন রোগী ও অপরজন বাহক হয়, তাহলে এ সম্ভাবনা দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। উভয়েই রোগী হলে তাদের প্রতিটা সন্তানই রোগী হবে। তবে স্বামী ও স্ত্রীর একজন বাহক ও একজন সুস্থ হলে তাদের সন্তানদের কেউই এই রোগে আক্রান্ত হবে না, যদিও তাদের সন্তানদের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ। এজন্য চিকিৎসকরা বলছেন, বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ে তাদের বিয়ের আগে এই রোগের জিনবাহক কিনা তা জেনে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ নারী-পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে থ্যালাসেমিয়া রোগটি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেই তাদের বিপত্তিতে পড়তে হয়। এ ছাড়া বাহকের সঙ্গে বাহকের বিয়ে হয়ে গেলে থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করার জন্য গর্ভাবস্থায় গর্ভের ১১ থেকে ১৩ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ ভ্রম্নণ পরীক্ষা করেও জানা সম্ভব গর্ভের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কিনা।

থ্যালাসেমিয়া কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কিন্তু এর লক্ষণ হলো প্রধানত রক্ত সল্পতা বা অ্যানিমিয়া। শরীরে রক্ত কম থাকার কারণে অক্সিজেন লেভেল কমতে শুরু করে। অল্পতেই রোগী ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। পেট ফুলে যাওয়া, ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া, মুখের হাড়ের পরিবর্তনও হতে দেখা যায় থ্যালাসেমিয়া রোগীর। তাই এসব লক্ষণ যদি আপনার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ মানুষ একটু সচেতন হলেই মারণঘাতী এই রোগটি প্রতিরোধ করা অসম্ভব নয়।

থ্যালাসেমিয়া রোগীকে সুস্থ রাখতে প্রাথমিক চিকিৎসা হলো নির্দিষ্ট সময় পর পর রক্ত দেওয়া। কিন্তু এভাবে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। এজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনিম আহমেদ বলছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীর উন্নত চিকিৎসা হলো অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। আর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে করতে হবে। এ চিকিৎসার ভালো ফলাফল তখনই মিলবে যদি শিশুর শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে। তাহলেই রোগী চিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।

নিয়মিত রক্ত পরিবর্তন : থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরে বারবার লোহিত রক্ত কণিকার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। শরীরকে সচল করে রাখার জন্য তাই রোগীকে বারবার রক্ত দিতে হতে পারে।

চিলেশন থেরাপি : শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন অপসারণের জন্য যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই সাংঘাতিক হয়। ওষুধ না ব্যবহার করে এই থেরাপির মাধ্যমে আপনি রোগীকে সুস্থ করতে পারবেন।

আয়রন সমৃদ্ধ খাবার : থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আয়রন ওভারলোড উদ্বেগজনক হলেও রক্তে হিমোগেস্নাবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন আয়রন সমৃদ্ধ খাবার। তবে আয়রন সাপিস্নমেন্ট এড়িয়ে চলতে হবে অবশ্যই।

হাইড্রেশন : থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে যেহেতু রক্তের অভাব থাকে তাই রোগী যাতে ডিহাইডেট্রেড না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া রক্তে হিমোগেস্নাবিন, আয়রনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।

সংক্রমণ এড়ানো : থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেহেতু খুবই কম থাকে তাই যাতে রোগীদের শরীরে কোনোভাবে সংক্রমণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি রোগীদের পাশে সব সময় হাসিমুখে থাকতে হবে যাতে রোগী মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে। জাতিকে থ্যালাসেমিয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজন জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বিদ্যমান থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার (মেডিকেল ও নিরাময়যোগ্য) ব্যবস্থা করা উচিত। পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে, যাতে আগামী পাঁচ বছরে কোনো থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম না হয়। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান পদ্ধতি হলো স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম। প্রাথমিকভাবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গ্রম্নপের জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (অর্থাৎ ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি তরুণ প্রজন্মের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের) অনতিবিলম্বে শুরু করা।' জীবনের ক্ষমতায়নে অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসায় সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা'। যেটি ছিল এ বছরের থ্যালাসেমিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য। তাই এ প্রতিপাদ্যকে লক্ষ্য রেখে জনগণকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ সচেতনতাই পারে থ্যালাসেমিয়া রোগী ও বাহকদের উন্নত জীবন যাপনে সহায়তা করতে এবং থ্যালাসেমিয়া মুক্ত পরিবার, সমাজ ও দেশ এবং সর্বোপরি একটি সুস্থ পৃথিবী বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে। যেখানে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায়ন ও টেকসই উন্নয়নের অভীষ্টসমূহ বাস্তবায়নে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এখন বর্তমান সময়ের জোরালো দাবিদার।

সুমাইয়া আকতার

সরকারি ব্রজমোহন কলেজ

বরিশাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে