চাই সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি
সুস্থ চিন্তাধারাকে যুক্ত করার মাধ্যমে রুগ্ণ দশা থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। যে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সুবিধা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবে। একদিন নিশ্চয় ছাত্ররাজনীতি সব বিতর্ক কাটিয়ে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হবে। ছাত্র সংগঠনগুলো সুশৃঙ্খল ও গতিশীল হবে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
প্রকাশ | ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
সাগর জামান
আমাদের ছাত্ররাজনীতির রয়েছে গৌরবময় অতীত। অতীতে ছাত্ররা নিজেদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি জনকল্যাণের প্রয়োজনে স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ছাত্ররাজনীতিতে নিবেদিত থেকেছেন। ছাত্ররা দ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে তারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন গৌরবদীপ্ত ঘটনার সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত রাখতেন। দেশ, মাটি ও মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকত ছাত্রসমাজের। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও আত্মত্যাগ ইতিহাসে দীপ্যমান। যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা গতিবেগ সঞ্চার করেছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের দীপ্তকণ্ঠ প্রকম্পিত করেছে চারদিক। ছাত্রদের নানা স্স্নেস্নাগানে মুখর হয়েছে। ছাত্রসমাজ কণ্ঠে অনেক ধরনের স্স্নেস্নাগান ধারণ করেছেন এবং সেগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলেছে যেমন 'জয় বাংলা', 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি', 'রক্ত সূর্য উঠেছে বীর বাঙালি জেগেছে'। এই সব স্স্নেস্নাগান জনগণের চেতনাকে আলোড়িত করত- যা আজো মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন শাসকদের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ছাত্রসমাজ।
কিন্তু বর্তমানে ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতি বিমুখতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা খুব বেশি চোখে পড়ে না। ছাত্ররাজনীতির বেপরোয়া গতি প্রকৃতি অনেককেই শংকিত করে তুলছে। ছাত্ররাজনীতিতে স্খলনের চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে। আদর্শিক জায়গায় অনড় থাকা ছাত্ররাজনীতির নেতৃবৃন্দের সংখ্যা কমে গেছে। বলা যায় মূল থেকে অনেকেই বিচু্যত হয়ে পড়েছে। জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ কমে গেছে অনেকাংশে। ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়েছে। ছাত্ররাজনীতির সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ছাত্রনেতা কর্মীদের লোভ গ্রাস করছে। অর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তির লালসায় মত্ত থাকে অনেকে। তারা অর্থের দিকে ছুটছে কেবল। বিশুদ্ধ রাজনীতি করছে না। চাঁদাবাজি, মাদক, মারামারি, যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, রিগিং, হল দখল, সিট দখল, খুনোখুনি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়ে নিয়ে যাওয়া, ডাইনিংয়ে খেয়ে দাম না দেওয়া, ও টেন্ডারবাজিসহ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আদু ভাইয়ের সংখ্যাও কম নয়। একবার নেতৃত্ব পাওয়ার পর ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরেও ছাত্রনেতা হয়ে ছাত্র নামধারী অছাত্ররা দীর্ঘদিন থেকে যাওয়ার মতো উদাহরণ রয়েছে। যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। চরম অনীহা সৃষ্টি হয়েছে ছাত্ররাজনীতির প্রতি। মেধাবীরা রাজনীতি করে না। রাজনীতির কথা শুনলে ভয় পায়। বলা যায় অতীতে ছাত্ররাজনীতির যে উজ্জ্বল ভাবমূূতি সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন ম্স্নান হয়ে গেছে।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ তৈরি হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে বিশাল সংকট তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণ হওয়া দরকার। এই সংকট থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে দেশের অগ্রগতি, উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কলেজ ছাত্র সংসদ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এতে ছাত্রদের ভেতর থেকে দক্ষ সংগঠক তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। অথচ ছাত্রজীবনেই নিজেকে যোগ্য দক্ষ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? হচ্ছে না। কেবল ছাত্ররাজনীতির ক্ষতি বৃদ্ধি হচ্ছে। ছাত্ররাই তো ভবিষতে দেশ পরিচালনা করবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। নানা সংকট আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এদেশের ছাত্ররাজনীতি। হিংসা-বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। ছাত্ররাজনীতি এখন এক ধরনের পেশায় পরিণত হয়েছে। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ছাত্ররাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন সুশিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরাও রাজনীতি করেন সে কারণে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রীতি গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কের সুযোগে ছাত্ররা অনেক সময় প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব নানা কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনেকের হতাশা আছে। এ কথা সত্য আশাও আছে। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। আসলে ছাত্ররাজনীতির খারাপ দিক সৃষ্টি হয়েছে যেমন ঠিক তেমনি ভালো দিকও যে একেবারে নেই তা নয়। বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলোর অনেক ভালো কাজের দৃষ্টান্তও রয়েছে। অনেক সংকটময় সময়ে ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা নিঃস্বার্থভাবে জনকল্যাণে কাজ করেছে, যা প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মানবিক আচরণ ও মানুষের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব এদেশের ছাত্রসমাজ ও জনগণের হৃদয়ে সম্মান ও ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে অনেক সময়। আসলে যেভাবেই হোক ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে। সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির বড় প্রয়োজন। আসলে প্রয়োজন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্ররাজনীতিকে অনুসরণ করা। কারণ জাতির পিতার আদর্শ আমাদের প্রধান অনুপ্রেরণা। তার আদর্শ ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ছত্রসমাজকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে।
ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব রয়েছে অনেক। তবু দীর্ঘদিন নির্বাচিত ছাত্র সংসদ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এ কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। অথচ ছাত্ররাজনীতি ব্যতীত জাতীয় রাজনীতি একেবারে অসম্ভব। ছাত্ররাই তাদের তেজদীপ্ত কাজের মাধ্যমে বর্তমানে এবং আগামীতে স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ছাত্ররাজনীতির বিরূপ চিত্র প্রত্যাশিত নয়। প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির চিত্র পীড়িত করে দিচ্ছে আমাদের। ছাত্ররাজনীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে ছাত্ররাজনীতিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিকে একীভূত করেেত হবে। জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্ররাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করলে মূল রাজনীতির গতিধারা থেমে যাবে। নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম চলমান রাখা উচিত। ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থ ধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় রাজনীতি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয় তাহলে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা সম্ভব হবে। ছাত্ররাজনীতি যদি সঠিক পথে যায় তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার সহায়ক পরিবেশকে বিঘ্নিত করে তা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য, নিজেকে পারদর্শী করার জন্য এবং দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ছাত্রসমাজকে প্রস্তুত হতে হয়। সে জন্য লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে হয়। গবেষণায় নিমগ্ন থাকতে হয়। দরকার হয় শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ। এই পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়। ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকার আদায় করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। এই কাজগুলোই হচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষা, অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্ররাজনীতি তাৎপর্যপূর্ণ।
সুস্থ চিন্তাধারাকে যুক্ত করার মাধ্যমে রুগ্ণ দশা থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। যে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সুবিধা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবে। একদিন নিশ্চয় ছাত্ররাজনীতি সব বিতর্ক কাটিয়ে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হবে। ছাত্র সংগঠনগুলো সুশৃঙ্খল ও গতিশীল হবে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
সাগর জামান : প্রাবন্ধিক