দাবদাহের কবলে পড়েছে দেশ। ৬৪-এর মধ্যে ৪২ জেলায় রয়েছে মৃদু থেকে মাঝারি দাবদাহ। তার দৌরাত্ম্যে পাঁচ বিভাগে হিট অ্যালার্ট জারি করতে হয়েছে। তীব্র গরমে হিটস্ট্রোকে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক মানুষ। দীর্ঘদিন আকাশে তীব্র রোদের আগুন, প্রকৃতিতে যেন লু হাওয়া বইছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকার জন্য সবাইকে কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শ্রমজীবী মানুষকে তো কাজে বেরোতেই হবে। তারা যতটা সম্ভব রোদ বাঁচিয়ে কাজ করতে পারলে ভালো। শরীরে যেন জলশূন্যতা সৃষ্টি না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির প্রচারণা প্রয়োজন। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের জেরে বিশ্বজুড়েই পরিবেশের সংকট দেখা দিয়েছে। ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। প্রকৃতি এত বিরাট এবং ব্যাপক আর তার শক্তি এতটাই সর্বব্যাপী যে, মানুষের সব প্রচেষ্টাই তাতে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। প্রকৃতির তান্ডবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয় জ্ঞান-গরিমায়, ধনে-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ সব উন্নত দেশও। প্রকৃতির রুদ্ররূপ থেকে রক্ষা পেতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রচুর গাছ লাগিয়ে বিস্তৃত বনভূমি গড়ে তুলতে হবে। জলাশয় রক্ষা এবং নতুন জলাধার সৃষ্টি করতে হবে। রুষ্ট প্রকৃতিকে নানাভাবে শীতলতার পরশ দিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনতে এগুলো কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে।
দুই হাজার বছরে এমন গরম দেখেনি বিশ্ব। উত্তর গোলার্ধে দূর অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ২০২৩-এর গ্রীষ্ম বেশি গরম ছিল। গবেষণা বলছে, এবারের গ্রীষ্ম গত বছরের উষ্ণতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এল নিনো আবহাওয়া চক্রের সঙ্গে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব উত্তপ্ত হতে থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে গবেষকদের ধারণা। এর প্রভাবে অস্বাভাবিক গরম ও খরা; অসময়ে বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। আশঙ্কা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশেও এর আঘাত আসতে পারে। আসছেও। তার কিছু আলামত ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে।
দাবদাহের প্রচন্ড গরমে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গরম বেশি পড়ছে, এটি সত্য হলেও অন্যান্য বাস্তবতাও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাপ শোষণকারী উপাদানের অভাব ঘটেছে প্রকৃতিতে। আর এ জন্যে আমরাই দায়ী। আমরা খাল-বিল ও নদী-নালা ভরাট করেছি। ফলে, জলীয় বাষ্পের ঘাটতিতে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে চলেছে। এ কারণে আরও বেশি করে গরম অনুভূত হচ্ছে। গাছ কেটে ফেলা আরও একটি আত্মঘাতী কর্মকান্ড। ফলে, সুশীতল ছায়ার আধার আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বড় সড়কের পাশের গাছ কেটে ফেলায় পিচঢালা পথ আগুনের মতো তেতে উঠছে সূর্যের আলোয়। তাপমাত্রা বাড়ছে প্রকৃতিতে। রাস্তার দু'ধারে আগের মতো গাছ থাকলে মানুষ গরমে এত বেশি কষ্ট পেত না।
গরমের মধ্যে ঢাকাসহ অনেক জায়গায় লোডশেডিং বেড়েই চলেছে। মানুষ যেখানে ফ্যানের নিচে থেকেও ঘামছেন, সেখানে বিদু্যৎ বন্ধ থাকলে কতটা কষ্ট পোহাতে হয়, সেটি ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। বিদু্যতের অভাবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আধুনিক জীবন নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এমনকি গ্রামাঞ্চল। বিদু্যতের চাহিদা বেড়ে যায় তীব্র গরমে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় এসির ব্যবহারও বাড়ছে। এসি কক্ষকে শীতল রাখছে, এতে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে বায়ুমন্ডলে সেটি উষ্ণ বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলেও তাপমাত্রা বাড়ছে।
বিদু্যৎ বিতরণে সংকট থাকলে পানির হাহাকারও শুরু হয়। পানি উৎপাদন ও সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। ঢাকার কয়েকটি এলাকায় তীব্র পানি সংকটও রয়েছে। প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়া গেলে জীবন স্থবির ও বিপন্ন হয়ে পড়ে।
তীব্র গরমের কারণে নাজেহাল হচ্ছে জনজীবন। তীব্র গরমে দেশব্যাপী হাজার হাজার দিনমজুর কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তীব্র গরমের মধ্যে দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। লোডশেডিংয়ের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
গরমের তীব্রতা সম্পর্কে একজন রিকশা চালকের বক্তব্য, গরম এত বেশি যে রিকশা চালাতে পারছি না। এত গরম কখনো দেখিনি। খুবই কষ্ট হচ্ছে রিকশা চালাতে। সারাদিনে দুই ট্রিপ দিয়েছি। তাতেই জীবন যায় যায় অবস্থা। মনে হয় শরীরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। রোদের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সামনে কোরবানি, তাই ছেলে-মেয়েদের কিছু কাপড়-চোপড় কিনে দিতে হবে। তা না হলে এই রোদে বের হতাম না।
তীব্র গরমে শিশু ও বয়স্করাই বেশি কষ্ট ভোগ করে এবং স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে থাকে। এ সময়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই। খাবার, পোশাক এবং চলাচল- এ তিনটি বিষয়ে সচেতনতা অবলম্বন করলে অসুস্থতা রোধ করা যাবে। সাদা রঙের হালকা ও সংক্ষিপ্ত পোশাক পরার কথা বলেন ডাক্তাররা। খাওয়ার বিষয়ে বলেন টাটকা খাবার খেতে। বাসি, কিংবা সামান্য নষ্ট হওয়া খাবার খাওয়া যাবে না। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
প্রয়োজনে অল্প লবণমিশ্রিত পানি পান করা যেতে পারে। ডাবের পানিও উপকারী। তরমুজও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। তরমুজসহ রসালো ফল খাওয়া যেতে পারে। রোদের ভেতরে বাইরে যাওয়া হতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এতে অনেক সময় বয়স্ক ব্যক্তির জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়। রোদে যেতে বাধ্য হলে মাথায় কাপড় বা ছাতি ব্যবহার আবশ্যক।
মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা ও অপরিণামদর্শী কর্মকান্ড এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে মরুভূমির মতো যে গরম পড়েছে, তা থেকে আগামী দিনগুলোতে রেহাই পেতে হলে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নিতে হবে। সেইসঙ্গে নদী-নালা ও খাল-বিল সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের তৎপর হতে হবে।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ