প্রতিবছরের ন্যায় এবারও শাহ আব্দুল হামিদের মৃতু্যবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির উদ্যোগে গাইবান্ধা জেলা ক্রীড়া সংস্থায় পালিত হলো। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের খলসী গ্রামে ১৯০০ সালে এক সম্ভ্রান্ত কৃষিজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন হাজী আব্দুল গফুর শাহ এবং মাতা রহিমা খাতুন। শাহ আব্দুল হামিদ নিজ গ্রামসংলগ্ন কাইয়াগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে গোবিন্দগঞ্জ হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৬ সালে ঐ স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা গিয়ে রিপন কলেজে ভর্তি হন। সে সময় তিনি বেকার হোস্টেলে থাকতেন। ১৯১৮ সালে আই.এ পাস করার পর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হন। কারমাইকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ১৯২০ সালে শাহ আব্দুল হামিদ বি.এ পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে এম.এ করার জন্য ভর্তি হন। ১৯২১-২২ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে যে সব ছাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছিলেন, শাহ আব্দুল হামিদ ছিলেন তাদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম ছাত্র। সে কারণে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাকে অভিনন্দিত করেন। আপাতত ছাত্রজীবনের ইতি ঘটে শাহ আব্দুল হামিদের। বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের পর নিজ গ্রামে ফিরে আসনে তিনি। কিছুদিন পর পলাশবাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯২৪ সালে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। সেখান থেকে বি.এল পাশ করে এলাকায় ফিরে ১৯২৮ সালে গাইবান্ধা আদালতে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। অল্প দিনের মধ্যেই শাহ আব্দুল হামিদ একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আইন ব্যবসার পাশাপাশি শাহ আব্দুল হামিদ রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে থাকেন। প্রথম দিকে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ১৯৩৭ সালে ভারতীয় মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি গাইবান্ধা মহকুমা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি গোবিন্দগঞ্জ থানার পশ্চিম অঞ্চল হতে রংপুর জেলা বোর্ডের সদস্য পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। একই বছর প্রখ্যাত রাজনীতিক আবু হোসেন সরকার রংপর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং শাহ আব্দুল হামিদ ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকার সুবাদে তিনি প্রখ্যাত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৫ সালে পাকিস্তান ইসু্যতে ভারতব্যাপী যে নির্বাচন হয় তাতে শাহ আব্দুল হামিদ মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টে সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ পার্লামেন্টে মুসলিম লীগের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, আই আই চুন্দ্র্রিগড়সহ মোট ৩০ জন নির্বাচিত হন। আর ভারতীয় কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত হন পন্ডিত জহরলাল নেহেরু, সর্দার বলস্নভভাই প্যাটেল, জগজীবন রাম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে শাহ আব্দুল হামিদ ও তমিজ উদ্দিন খান দিলস্নীতে ২৯নং ফিরোজ শাহ রোডের একটি সরকারি বাসভবনে থাকতেন। ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শাহ আব্দুল হামিদ ১৯৫৭-৬৬ সাল রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। শাহ আব্দুল হামিদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভু্যত্থানে তিনি রংপুরে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শাহ আব্দুল হামিদ গোবিন্দগঞ্জ-পলাশবাড়ী এলাকা হতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। একাত্তরে মহকুমা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। দেশ স্বাধীন হলে ডিসেম্বরের শেষ দিকে গাইবান্ধা ফিরে আসেন তিনি। বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের সমর্থনে শাহ আব্দুল হামিদ বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম স্পীকার নির্বাচিত হন। শাহ আব্দুল হামিদ রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কলকাতায় পড়ার সময় তিনি খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ফুটবলের রেফারি হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে কলকাতা ফুটবল লীগের ২য় বিভাগে বহু খেলা পরিচালনা করেন। গাইবান্ধায় ফিরে তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং দীর্ঘদিন গাইবান্ধা টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই ক্লাবটিই তখন মহকুমার সব খেলাধুলা পরিচালনা করত। তখনকার জমিদার আব্দুল মজিদের আর্থিক সহায়তায় আইএফএ শীল্ডের অনুকরণে গাইবান্ধা 'খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ শীল্ড ফুটবল' চালু করেন শাহ আব্দুল হামিদ। দেশের বিভিন্ন স্থানের সেরা ফুটবল দলগুলো এ টুর্নামেন্টে অংশ নিত। তার উদ্যোগেই ১৯৩৯ সালে কলকাতা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এবং কালীঘাট ক্লাবকে গাইবান্ধায় এনে ফুটবল খেলানো সম্ভব হয়। শাহ আব্দুল হামিদের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই গাইবান্ধা ফুটবলে উত্তরাঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং অনেক খ্যাতিমান ফুটবলার সৃষ্টি হয় গাইবান্ধাতে।
গাইবান্ধার নাট্যাঙ্গনেও যুক্ত ছিলেন শাহ আব্দুল হামিদ। জর্জ করনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেন। কর্ণ অর্জুন নাটকে কর্ণের চরিত্রে শাহজাহান নাটকে আওরঙ্গজেবের চরিত্রে, বর্গির হাঙ্গামা নাটকে ভাস্কর পন্ডিতের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরী এন্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন।
গাইবান্ধার শিক্ষা বিস্তারে শাহ আব্দুল হামিদ স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। ১৯৪৭ সালে গাইবান্ধা কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সম্পাদক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি রংপুর স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় স্কুল বোর্ড জেলার প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করত। স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান হবার সুবাদে তিনি গাইবান্ধা মহকুমার বহু প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শিক্ষক স্বল্পতা নিরসনে অনেক শিক্ষক নিয়োগ করে এলাকার শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান করে দেন। সে সময় ডাকবিভাগের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক বেতন পেতে অনেক দেরি হতো। শাহ আব্দুল হামিদের বিশেষ উদ্যোগে শিক্ষকদের বেতন মানি অর্ডার করার জন্যই জেলা বোর্ড অফিসের একটি কক্ষ বরাদ্দ করে পোস্ট অফিসের বিশেষ শাখা খোলা হয়। ১৯৫১ সালে শাহ আব্দুল হামিদ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের একজন পরিচালক মনোনীত হন। সে সময় তিনি এ অঞ্চলের স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের অনেক শিক্ষিত যুবককে চাকরি লাভের সুযোগ করে দেন। ১৯৫৩ সালে তারই উদ্যোগে গাইবান্ধায় ন্যাশনাল ব্যাংকের (বর্তমান সোনালী ব্যাংক) ১৯তম শাখাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের পরিচালক ছিলেন। কর্মজীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য স্মরণীয় শাহ আব্দুল হামিদ ১৯৭২ সালের ১ মে দিবাগত রাত সাড়ে বারটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যরণ করেন। তাকে গাইবান্ধা পৌর গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। কর্মযোগী এই মানুষটি তার উত্তরসূরি হিসেবে দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। পুত্র সন্তান হিসেবে অ্যাডভোকেট শাহ ফিরোজ কবীর ও অ্যাডভোকেট শাহ জাহাঙ্গীর কবীর (সাবেক সংসদ সদস্য গোবিন্দগঞ্জ-০৪) তারা উভয়ে প্রয়াত। গাইবান্ধা জেলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শাহ আব্দুল হামিদের দুই সুযোগ্য দৌহিত্র অ্যাডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবীর মিলন (সাবেক মেয়র, গাইবান্ধা পৌরসভা ও সহ-সভাপতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, গাইবান্ধা জেলা শাখা) অপরজন শাহ সারোয়ার কবীর (সংসদ সদস্য গাইবান্ধা-০২ ও সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, গাইবান্ধা জেলা শাখা)। তারা উভয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
ইসলাম শফি : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ধর্মপুর আব্দুল জব্বার ডিগ্রী কলেজ