অগ্নিদুর্ঘটনা :ব্যবস্থাপনা ও আমাদের করণীয়

অগ্নিদুর্ঘটনা এমন একটি দুর্যোগ, যা খুব অল্পসময়ে ব্যাপক জান ও মালের ক্ষতিসাধন করতে পারে। বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিভিন্ন অগ্নিদুর্ঘটনা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে কিন্তু এখনো জনসাধারণ অগ্নিদুর্ঘটনার উৎসগুলো সম্পর্কে সচেতন নয়। সামাজিকভাবে এই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

প্রকাশ | ২০ মে ২০২৪, ০০:০০

মেজর মো. শাহরিয়ার হাসান, পিএসসি, এএসসি
১। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে মনুষ্য প্রভাবিত দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো অগ্নিদুর্ঘটনা। প্রতিবছরই অগ্নিদুর্ঘটনায় ব্যাপক জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়। ২০২৩ সালে সারাদেশে সর্বমোট ২৭ হাজারের বেশি অগ্নিদুর্ঘটনায় ১০০ জনের বেশি প্রাণহানি ঘটে, ২৮১ জন গুরুতর আহত হয় এবং ৭০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ বিনষ্ট হয়। ঢাকা দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ায় অনেক এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে উঁচু বিল্ডিং, শপিংমল, হসপিটাল, বিশ্ববিদ্যালয়, বস্তি গড়ে উঠেছে। নগরায়ণের ব্যাপক অগ্রগতির ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দালান বানানোর নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই অসংখ্য দালান তৈরি করা হয়েছে। দালান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন নন। বরং অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে ব্যবসায়িক মুনাফাই বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। শুধু ঢাকা-শহরে প্রতিদিন গড়ে ৫টি ছোট-বড় অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। গত ২০২২ সালের অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটার প্রবণতা থেকে দেখা যায়, বাসাবাড়ি এবং বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লাগার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এবং বার্ষিক পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী ৩৫.৫২% অগ্নিদুর্ঘটনা ইলেকট্রিক শর্টসার্কিট থেকে, ১৭.৭৬% জলন্ত সিগারেট থেকে, ১৫.১১% বিদু্যৎ এবং বৈদু্যতিক সামগ্রী থেকে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। অগ্নি নিরাপত্তা অ্যাক্ট ২০০৩ অনুযায়ী সব উঁচু দালান ও বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ সব স্থাপনাতে অবশ্যই অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই অ্যাক্ট অনুযায়ী ছয়তলা এবং এর চেয়ে উঁচু দালানের ক্ষেত্রে অবশ্যই জরুরি বহির্গমন, জরুরি বৈদু্যতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং উঁচু দালানের ক্ষেত্রে অবশ্যই কন্ট্রোল রুম এবং গ্যাস ও তাপ নিরোধক পদ্ধতি থাকতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাপনায় কিছু লোককে পারদর্শী হতে হবে। কিন্তু এ রকম হাইরাইজড বিল্ডিং, হোক সে আবাসন বা বাণিজ্যিক কোনো ক্ষেত্রেই এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতে মালিক পক্ষকে দেখা যায় না। এ ছাড়া দালান নির্মাণে আইন ১৯৯৬ মতে, যে কোনো দালান মেইন বৈদু্যতিক লাইন হতে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মধ্যে কমপক্ষে ২.৫ মিঃ দূরত্ব থাকতে হবে। অবশ্যই দালানে জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটনে বিল্ডিং অ্যাক্ট ২০০৭-এর সেকশন ৬৭তে অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কে বিশেষভাবে বর্ণিত রয়েছে। এই অ্যাক্ট অগ্নি প্রতিরোধক অ্যাক্ট ২০০৭ সালের সব নিয়মকে সমর্থন করে এবং জরুরি বহির্গমন পথ, দালান অনুযায়ী যেমন হওয়া উচিত সেটিও বর্ণনা করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশিরভাগ ভবন মালিক, হোক ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা প্রতিষ্ঠান এসব নিয়মকানুন অনুসরণ করা তো দূরে থাক বরং এসব নিয়মকানুনের অস্তিত্ব সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল নন। বিশাল কর্মপরিধিযুক্ত রাজউকের ক্ষুদ্র জনবল দিয়ে ঢাকা-শহরের মতো জায়গায় উঁচু দালান তৈরি ও ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতি মানতে বাধ্য করা সম্ভব নয়। ২। অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ বুঝতে গেলে দেখা যায়, আইন-কানুনের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব একটি মুখ্য কারণ। শুধু যদি পুরান ঢাকার এলাকার ওপর নজর দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, বেশির ভাগ বিল্ডিংয়েরই রাজউকের কোনো অনুমোদন নেই। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ছয়তলার ওপর কোনো দালান লিফট ব্যতীত করা যাবে না। দশ তলা ও এর অধিক তলা দালানের ক্ষেত্রে লিফট এত প্রশস্ত হতে হবে যে, যাতে এতে স্ট্রেচারসহ রোগী নেওয়া যায়। লিফটের জন্য সার্বক্ষণিক জেনারেটর সাপোর্ট অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এসব নিয়ম অনুসরণ করতে দেখা যায় না। এ ছাড়া অল্প কিছু পরিকল্পিত এলাকা এবং রাস্তা ব্যতীত ঢাকা-শহরের বেশিরভাগ এলাকায় অত্যন্ত সরু রাস্তা দেখা যায় যা জরুরি সময়ে ফায়ার সার্ভিসের যানবাহন ঢুকতে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। যার ফলে অগ্নি নির্বাপণ সহায়তাকারী সংস্থার রেসপন্স টাইম বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ছোট দুর্ঘটনাও বড় ক্ষতিতে রূপ নেয়। এ ছাড়া ঢাকা-শহরের বেশিরভাগ এলাকায় প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর বিলুপ্তি হচ্ছে। অনেক খাল বেদখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে এবং ঢাকা-শহরের রাস্তায় কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম না থাকায় বড় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পানির সংকটও দেখা দেয়। এ ছাড়া এখন ঢাকা-শহরের ভূমি ব্যবহারের কোনো জোনিং সিস্টেম কার্যকরী হয়নি যার ফলে একই এলাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, কল-কারখানার মিশ্রণ দেখা যায়। যেহেতু দেশের অন্য জেলা থেকে ঢাকা জেলার জনবসতি প্রায় বেশি তাই এসব কারণে অন্য শহরের চেয়ে ঢাকা-শহরে অগ্নি দুর্ঘটনার হারও বেশি। ৩। দেশে মোট ৫৩৪টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে এবং ঢাকা-শহরে মোট ১৮টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে এবং দুর্ঘটনার প্রবণতার ৩। ওপর ভিত্তি করে এই স্টেশনগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ক শ্রেণি: সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বও সবচেয়ে বেশি। খ শ্রেণি: মাঝারি গোছের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বও মাঝারি। গ শ্রেণি: কম দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বও কম। এসব ফায়ার স্টেশন সর্বমোট ৫০০ বর্গ কিমির বেশি এলাকায় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। হায়দ্রাবাদ মেট্রোপলিটনে ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এনভায়রনমেন্টাল বিল্ডিং গাইড লাইন অনুযায়ী দুই লাখ জনবসতি সম্পন্ন একটি এলাকার ০১ থেকে ০৩ কিমির মধ্যে কমপক্ষে একটি ফায়ার স্টেশন অথবা সাব ফায়ার স্টেশন থাকবে এবং সর্বোচ্চ কাভারেজ এরিয়া হতে পারে ৩০ কিমি। ঢাকা-শহরের ফায়ার স্টেশনগুলোর গড় কাভারেজ এরিয়া ৩০ বর্গ কিমি এবং প্রতি স্টেশনের অধীন জনবসতির পরিমাণ ১০ লাখের বেশি। ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (এনএফপিএ) মত দেয় যে প্রতি ২ হাজার মানুষের জন্য একজন ফায়ার ফাইটার কর্তব্যরত থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফায়ার স্টেশন ভেদে এই সংখ্যার ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার অর্থাৎ এতজন লোকের জন্য একজন ফায়ার ফাইটার কর্তব্যরত থাকেন। ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (এনএফপিএ) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অগ্নি দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আদর্শ সময় হওয়া উচিত ০৫ মিনিট ২০ সেকেন্ড। কিন্তু ঢাকা-শহরের কোনো ফায়ার স্টেশনই এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অগ্নি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোয় এমনকি দুর্ঘটনাস্থলেও পৌঁছাতে পারে না। এর কারণ হিসেবে অপ্রশস্ত রাস্তা, উৎসুক জনতার ভিড় এবং ঠিক সময়মতো ফায়ার সার্ভিসের কাছে সংবাদ না পৌঁছানোকে দায়ী করা যায়। এ ছাড়া আরেকটি মূল সমস্যা হলো শুধু ঢাকাতেই প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে দরকারি সরঞ্জামাদি ও লোকবলের অভাব রয়েছে। শুধু ঢাকাতে যেসব ফায়ার স্টেশন রয়েছে সেখানে ফায়ার স্টেশনের শ্রেণিভেদ অনুযায়ী ২০-৩৫ জন প্রশিক্ষিত ফায়ারম্যান রয়েছে। সব ফায়ারম্যান সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা অনবরত ডিউটির পরে ২৪ ঘণ্টা কর্তব্য থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের ফায়ার স্টেশনগুলোতে লোকবলের সংকট থাকায় এই বিরতি দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। যা ফায়ারম্যানদের ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ তৈরি করে। যদি আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্র দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাই, দিলিস্নতে প্রতি ১০ হাজার ৬০ জনের জন্য একজন ফায়ার ফাইটার রয়েছে। নিউইয়র্কে প্রতি ৭৫ জন লোকের জন্য একজন ফায়ার ফাইটার রয়েছে। সুতরাং শুধু বাংলাদেশে প্রতি জনের জন্য ফায়ারম্যানের অনুপাতে দিলিস্নর প্রায় ৫ গুণ এবং নিউইয়র্কের প্রায় ২০০ গুণ বেশি। এ ছাড়া অগ্নি নির্বাপনে স্বেচ্ছাসেবক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমেরিকাতে প্রায় ৬৪ ভাগ ফায়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে থাকে। অথচ স্বেচ্ছাসেবকরা ফুলটাইম ফায়ারম্যানদের মতো বেতন-ভাতা প্রাপ্ত হন না। এ ছাড়া কানাডাতে গ্রাম্য এলাকাতে স্বেচ্ছাসেবক অগ্নিনির্বাপক দল দেখতে পাওয়া যায়। কানাডায় প্রায় দুই লাখ এ রকম স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করছে। অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে স্বেচ্ছাসেবক ফায়ার সার্ভিস দল রয়েছে যারা বুশফায়ার, বিপদজনক দ্রব্য উদ্ধার এমনকি নিয়মিত ফায়ার সার্ভিসের পরিপূরক হিসেবে সব কাজ করে থাকে। চিলিতে ফায়ার সার্ভিসের ১০০% স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসে স্বেচ্ছাসেবক তৈরির জন্য নিয়মিত কোনো প্রশিক্ষণ ফোর্স নেই। ২০১১-১৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপির সহযোগিতায় বেশকিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল কমপক্ষে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা যারা অগ্নি নির্বাপন, উদ্ধারকাজ চালনাতে পারদর্শী হবে। তিনটি বড় সিটি কর্পোরেশনে যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে স্বেচ্ছাসেবক বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালনা করা হয় এবং ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ফায়ারম্যান তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ভূমিকম্পের সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার এলাকাতে প্রতি শহরে কমপক্ষে ২০০ স্বেচ্ছাসেবক প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এসব স্বেচ্ছাসেবকদের নাম, ঠিকানা নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশনে সংগৃহীত রাখা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই দ্রম্নত সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেই। এ ছাড়া ফায়ার স্টেশনে অগ্নি নির্বাপনকারী যানবাহন অগ্নিনির্বাপনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব যানবাহনের বৈশিষ্ট্যও এমন হওয়া উচিত যা ওই এলাকার অবকাঠামো ও ভূতপূর্ব অগ্নি দুর্ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়াতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্দেশাবলিতে দেওয়া আছে, প্রতি ফায়ার স্টেশনে কমপক্ষে তিনটি বাহন অবশ্যই থাকতে হবে তা হলো : ক। ওয়াটার টেন্ডার খ। এক্সট্রা হেভি ওয়াটার টেন্ডার এবং গ। অ্যাম্বুলেন্স ৪।এ ছাড়া এলাকার অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে আরও অতিরিক্ত সরঞ্জামাদি থাকতে হবে যেমন : টার্ন টেবিল মই, হাইড্রোলিক পস্নাটফর্ম, মোটর সাইকেল মিস্ট, ফোম টেন্ডার ইত্যাদি। দেশের বেশিরভাগ ফায়ার স্টেশনে এসব যানবাহন বিদ্যমান। আমাদের দেশে ক, খ, গ শ্রেণির ফায়ার স্টেশনে ১টি করে ওয়াটার টেন্ডার বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ঢাকা-শহরের উঁচু দালানের কথা বিবেচনা করে সব ফায়ার স্টেশনে টার্ন টেবিল ল্যাডার নেই। অথচ অন্তত ক শ্রেণির ফায়ার স্টেশনের কমপক্ষে ১৪ তলা হাইরাইজড বিল্ডিংয়ের অগ্নিনির্বাপনে সক্ষমতা থাকা উচিত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (বিএফএসসিডি) সদর দপ্তরে রক্ষিত টার্ন টেবিল ল্যাডারসহ অন্য বিশেষ যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভর করতে হয়। কয়েকটি ফায়ার স্টেশনে ৪-৮ তলা পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা থাকলেও এর ওপর দালানের জন্য মিরপুরে রক্ষিত বিশেষ যান ও যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর জন্য কালক্ষেপণের কারণ হয়। আর ঢাকার বাইরের শহরের জন্য এ সমস্যা আরও জটিল। অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে : ক। অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ভূমি ব্যবহারের জোনিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ জাতীয় ভবন ব্যবস্থাপনা কোড ২০১৪ অনুযায়ী পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে দালানের ব্যবহারের প্রকারভেদ পরিবর্তন করা যাবে না। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ভবনকে রাতারাতি বসবাসের ভবন কিংবা বসবাসের ভবনকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত করতে হলে অবশ্যই পূর্ব অনুমতি গ্রহণ করতে হবে কারণ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত দালানে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। খ। সরু রাস্তা অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার জন্য একটি জটিল সমস্যা। যেসব এলাকায় সরু রাস্তার সংখ্যা বেশি সেসব এলাকায় দুই চাকার ওয়াটার মিস্ট বেশি ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু মোটর সাইকেল ওয়াটার মিস্টের ধারণক্ষমতা কম থাকার কারণে বেশি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কিন্তু সরু রাস্তায় ব্যবহার করা যায় এমন যানবাহনের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। গ। প্রতিটি স্টেশনে উঁচু দালানে অগ্নিনির্বাপন যোগ্য বিশেষ যানবাহন এ ছাড়া তেল বা রাসায়নিক দ্রব্য থেকে উদ্ভূত আগুন নেভাতে যেসব সরঞ্জামাদি প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে বিশেষ যান ও সরঞ্জামাদির জন্য ফায়ার ব্রিগেড সদরের ওপর নির্ভরতা অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। ঘ। শুধু ঢাকাতেই প্রায় ১৩ হাজার লোকের জন্য একজন ফায়ারম্যান রয়েছে। অথচ আদর্শ হিসেবে প্রতি ২ হাজার লোকের জন্য একজন দায়িত্বরত ফায়ারম্যান থাকা উচিত। তাই প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এই ব্যবধান কমানো যেতে পারে। এ ছাড়া আরও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বর্তমানে ঘাটতি জনবলের অভাব পূরণ করা যেতে পারে। ঙ। এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনমাফিক আরও ফায়ার স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি দুই লাখ লোকের জন্য একটি ফায়ার স্টেশন থাকা উচিত। এটি বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনামাফিক আরও নতুন ফায়ার স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। চ। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করা যেতে পারে। শতকরা ৪০ ভাগ ক্ষেত্রেই অগ্নিনির্বাপক দল আসার আগেই জনগণ অগ্নিনির্বাপন করে ফেলে থাকে। তাই জনসাধারণ যদি অগ্নিনির্বাপনের আগে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে সচেতন হয় এবং অগ্নি দুর্ঘটনার উৎস সম্পর্কে সচেতন থাকে তাহলে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ভবন কিংবা স্থাপনায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ফায়ার ড্রিল অনুশীলনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এবং প্রয়োজনমাফিক স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাস এলাকায় ফায়ার ড্রিল অনুশীলনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৫। অগ্নিদুর্ঘটনা এমন একটি দুর্যোগ, যা খুব অল্পসময়ে ব্যাপক জান ও মালের ক্ষতিসাধন করতে পারে। বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিভিন্ন অগ্নিদুর্ঘটনা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে কিন্তু এখনো জনসাধারণ অগ্নিদুর্ঘটনার উৎসগুলো সম্পর্কে সচেতন নয়। সামাজিকভাবে এই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া পানির উৎসের যথাযথ ব্যবস্থা, সরু রাস্তার এলাকার ক্ষেত্রে বিকল্প রাস্তা তৈরি করা অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। রাজউকসহ অন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম অনুযায়ী দালান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভবন মালিকসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে তদারকি করতে পারে। সর্বশেষে আধুনিক যানবাহন ও বিশেষ সরঞ্জামাদিযুক্ত ফায়ার স্টেশন প্রতিষ্ঠা অগ্নিনির্বাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। তথ্যসূত্র: ১। ঢাকা ট্রিবিউন, ১৯ ফেব্রম্নয়ারি ২০২৪। ২। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স), বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। মেজর মো. শাহরিয়ার হাসান, পিএসসি, এএসসি : কলাম লেখক