পুরো ভারত মেতে আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক উৎসবে। পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির ভোটগ্রহণ শেষ হবে আগামী পহেলা জুন এবং ফল ঘোষণা করা হবে ৪ জুন। যেখানে প্রথমবারের মতো প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ভোট প্রদান করবে, যা বিশ্ব ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হতে চলছে। ভারতের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পুরো পৃথিবীর উৎসুক চোখ ভারতের দিকে। সবার মনে একই প্রশ্ন, বিজেপি না কংগ্রেস, কে নেতৃত্ব দেবে আগামীর ভারতকে?
গত এক দশক ধরে ভারত মেতে আছে মোদি ম্যাজিকে। আর যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রধান অস্ত্র সাম্প্রদায়িকতা। এ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির সুনির্দিষ্ট তেমন কোনো এজেন্ডা নেই, যা বিজেপিকে ভোটের মাঠে এগিয়ে রাখবে। কেবল মুসলিম বিদ্বেষ যেটাকে মোদি অস্তিত্ববাদের রাজনীতি বলছেন, সেটিই তার একমাত্র হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িকতাকে পুরো ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে মোদির মতো এত সফলভাবে আগে ভারতের কোনো শাসকই ব্যবহার করতে পারেননি। নির্বাচনের আগে বাবরী মসজিদের স্থানে নির্মিত রামমন্দির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মূলত নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদের কড়া বার্তা দিয়েছেন। বর্তমানে প্রতিটি নির্বাচনী সমাবেশেই তিনি সরাসরি সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি তার বিদ্বেষ প্রকাশ করছেন। এমনকি বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে আক্রমণ করছেন সাম্প্রদায়িকতা দিয়েই! তিনি বারবার ভারতের হিন্দুদের সতর্ক করছেন যে কংগ্রেস সরকার গঠন করলে সেই সরকার হিন্দুদের জমিজমা সহায়-সম্পত্তি সবকিছু মুসলমানদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেবে। সাধারণভাবে বলাই যায় তার এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলছে। এমনকি ভারতের প্রধান প্রধান শহরগুলোতেও বিজেপির সমর্থন বেড়েছে অনেকাংশে। এ ছাড়া লোকসভা নির্বাচনে একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে, দেশটির শিক্ষিত তরুণ ভোটাররা। কিন্তু এসব তরুণদের মধ্যেও বিজেপির প্রতি সমর্থন আগের যে কোনো সময়ের থেকে বেড়েছে।
এ ছাড়া বিজেপি নতুন করে আবার সামনে আনছে এনআরসি ইসু্য। এটিও নির্বাচনে বিজেপিকে এগিয়ে রাখছে। এই নির্বাচনে মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমাগত ছড়ালেও নরেন্দ্র মোদির নজর মুসলমানদের ভোটের দিকেও রয়েছে। গত নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায়, এতকিছুর পরও মুসলমানদের একটি উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ভোটার বিজেপিকে ভোট দিয়েছে এবং দিনদিন এ সংখ্যা বাড়ছেই। এক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ হয়তো কাজ করছে। আরেকটি কারণ হতে পারে বিজেপির আঞ্চলিক বেশকিছু দলের সঙ্গে জোট গঠন।
অন্যদিকে ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস গত নির্বাচনে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। রাহুল গান্ধীর অধীন কংগ্রেসের সময়টা গত একদশক ধরেই খারাপ যাচ্ছে। এ নির্বাচনে কংগ্রেস বিজেপি সরকারের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরছে। বিশেষ করে বেকার সমস্যা, বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংকট এসব বলে সাধারণ ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কংগ্রেসের এসব কথা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও সাড়া ফেলছে। এজন্য এবারের নির্বাচনে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সরকার গঠনের মতো আসন পাবে কি না এটি নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্বের ঘাটতি, জোটের ভেতরের বিবাদ, প্রগতিশীল রাজনীতির সংকট, এতসব ছাপিয়ে শেষপর্যন্ত বিজেপির মতো সুসংগঠিত দলকে পরাজিত করা হয়তো সম্ভব হবে না। এজন্য বলা যেতেই পারে সব ঠিক থাকলে হয়তো মোদি আবারও ভারতের ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ভারতে গেঁড়ে বসা হিন্দুত্ববাদ ভারতকে আরও ভয়াবহ এক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। এ ছাড়া ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি হয়েছে, সেটি ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কেননা ভারতে প্রগতিশীল রাজনীতির দলগুলো বর্তমানে একদমই সুবিধা করতে পারছে না। এমনকি বাম দলগুলোও যেন ভারতের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে।
ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় জাতি পৃথিবীতে খুবই কম রয়েছে। দেশটিতে হিন্দু ধর্মের মানুষ বাস করলেও, অন্য ধর্মের মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। কিন্তু ভারতে বিজেপি কেন্দ্রিক যে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি ছড়িয়ে পড়ছে এবং জনগণ বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় ভারত রক্ষার দায়িত্ব যেভাবে বিজেপিকে দিচ্ছে, তার ফলাফল ভবিষ্যতে হবে আত্মঘাতী। কেননা ভারতের মতো এত বিশাল জনগোষ্ঠী এবং বৈচিত্র্যময় সুবিশাল ভারতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িক এ গণতন্ত্র বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র চালু করতে হবে। যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে নয় বরং ভারতের নাগরিক হিসেবে সবাই বাস করবে।
শামীম মাহমুদ
ঢাকা