বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব

ডলারের দামের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ায় ব্যাংকগুলোকে নিজেদের দেওয়া প্রণোদনা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। সরকারি প্রণোদনা বহাল থাকবে। এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। ডলারের বড় মূল্যবৃদ্ধির সুফল পেতে সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন
  ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব

দেরিতে হলেও ডলারের দাম বাজারের বাস্তব দামের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদের হারও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদে এসব সিদ্ধান্ত ব্যবসায় চাপ তৈরি করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এর ভালো সুফল মিলতে পারে। ডলারের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে ১৫-১৬ হাজার কোটি টাকা। সেই বাড়তি রাজস্বের একটি অংশ জ্বালানি আমদানির বাড়তি খরচ মেটাতে ব্যয় করা হলে জ্বালানি ও বিদু্যতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন না-ও হতে পারে। নতুন করে ব্যবসার খরচ না বাড়লে দীর্ঘ মেয়াদে এ সিদ্ধান্তের সুফল মিলবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির ওপর কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব রাখবে, তবে অর্থনীতির স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো বিলম্বিত সিদ্ধান্ত। আরও আগে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা 'কম বেদনাদায়ক' হতো। সুদের হার বাজারভিত্তিক করার কারণে অর্থ ধার করার খরচ বাড়বে। এর ফলে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানারকম খরচ আছে। ঘুষ-দুর্নীতির কারণেও ব্যবসার খরচ বাড়ে। তবে দক্ষতা, সুশাসন, জবাবদিহি, দুর্নীতি হ্রাস- এসব নিশ্চিত করতে পারলে এর বিরূপ প্রভাব অনেক কমানো সম্ভব। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে 'ক্রলিং পেগ' পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দরের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। আইএমএফের চাওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পথে এগোয়। এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকভিত্তিক দুটো সংগঠন ডলারের দাম ঠিক করে আসছিল। সর্বশেষ তারা ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকায় নির্ধারণ করেছিল। মার্কিন ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগ বিনিময় পদ্ধতি চালু হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ডলারের জন্য 'ক্রলিং পেগ মিড-রেট' (সিপিএমআর) নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে আন্তঃব্যাংক ও গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেনে তফসিলি ব্যাংকগুলো সিপিএমআরের আশপাশে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করে। নতুন পদ্ধতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে বা কমবে। ফলে ডলারের দাম একবারে খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা নির্ধারণ না করে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ডলারের লেনদেনের ক্ষেত্রে এই দরের আশপাশে থাকতে হবে। ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার আগে এই পদ্ধতি চালু কার্যকরী একটি পদক্ষেপ। ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ টাকার নিচে বা ওপরে ডলারের কেনাবেচা করতে পারবে। তবে এই দরের চেয়ে খুব বেশি কম বা বেশি দামে ডলারের লেনদেন করা যাবে না। প্রতিদিন কত দামে ডলার কেনাবেচা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। ক্রলিং পদ্ধতি চালুর ফলে চলমান ডলার-সংকট অনেকটা কেটে যাবে আশা করা যায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কীভাবে এই পদ্ধতি চালু হবে, তা নিয়ে আইএমএফের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মার্চের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু করার কথা বললেও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাংকিং লেনদেনে ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়ার পর বেড়েছে খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম। বিভিন্ন মানিচেঞ্জার ও খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে। কেউ কেউ ১২৫ টাকায় ডলার কিনেছেন বলে জানিয়েছেন। কিছু দিন আগেও খোলাবাজারে ডলারের দাম ১১৮ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে 'ক্রলিং পেগ' পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর এতে ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। আগে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ছিল ১১০ টাকা। এ ঘটনার পর খোলাবাজারে ডলারের দামে প্রভাব পড়তে শুরু করে। নগদ ডলারের দর একবারে ৪-৫ টাকা বেড়ে ১২২-১২৩ টাকায় উঠেছে। খোলাবাজারের নগদ ডলার বেচাকেনা করেন যে ব্যবসায়ীরা, তারা জানিয়েছেন, এখন একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ ডলার কিনছেন না। ডলার কত টাকায় স্থির হবে, এটা বোঝার জন্য আগামী কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। ১১৮ টাকার ডলার এক দিনেই ১২৩ টাকায় ওঠে গেল। কেউ কেউ পারলে ১২৫ টাকাতেও বিক্রি করছে। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ব্যাংকগুলো ১১৮ টাকার মধ্যে ডলার বিক্রি করছে। তবে ব্যাংকগুলো পরিচিত মুখ ছাড়া অন্যদের ডলার দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর কাছে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলার মজুত রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, সেগুলো সঠিক ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। বেশ অনেক আগে থেকে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। অর্থনীতির স্বার্থে সবকিছু সঠিক পথে থাকতে হবে। তবে এটাও বলতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো বিলম্বিত সিদ্ধান্ত। এগুলো অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। এখন যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার প্রভাব তো থাকবেই। অর্থনীতির ওপর এসবের নেতিবাচক অভিঘাতও আসবে। তবে আরও আগে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা কম বেদনাদায়ক হতো। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানা রকম খরচ আছে। ঘুষ-দুর্নীতির কারণেও ব্যবসার খরচ বাড়ে। তবে দক্ষতা, সুশাসন, জবাবদিহি, দুর্নীতি হ্রাস- এসব নিশ্চিত করতে পারলে বিরূপ প্রভাব অনেক কমানো যায়। এখন সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে, তার সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিনিময় হারে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ডলারের দাম একবারে যতটা বেড়েছে, তা ক্রলিং পেগের সঙ্গে হয়তো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে এ সিদ্ধান্ত ঠিক আছে।

ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ আরও বাজারভিত্তিক করার ফলে প্রবাসী আয় অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল থেকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসবে। ফলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়বে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে ডলারের দাম বৃদ্ধি রপ্তানিকারকদের জন্য ভালো হবে। তাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা আরও বাড়বে। ডলারের বৃদ্ধি যদিও আমদানিকারকদের জন্য ভালো খবর নয়, তবে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য আগে থেকেই ১১৫ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ডলার কিনছিলেন। সুতরাং, তাদের ওপর অভিঘাত কম হবে। ডলারের দাম বাড়ার অভিঘাত বরং সরকারের ওপর বেশি হবে। কারণ, সরকার সার, জ্বালানি তেল, বিদু্যৎ, গ্যাস আমদানিতে আনুষ্ঠানিক দরে ডলার কিনতে পারত। এখন এসব পণ্য আমদানিতে সরকারকে আরও বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। ভোক্তার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের প্রভাব থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত সরকারি যেসব সংস্থা রয়েছে, যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তাদের আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। সরকারকে ভালো বাজার ব্যবস্থাপনা ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ও ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধি ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদ এবং আমদানি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপের পর এখন কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসার খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, ব্যবসার খরচ বেড়ে গেলে পণ্যমূল্য আরেক দফা বাড়বে। তাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, ফলে সাধারণ মানুষ আরও চাপে পড়বে। প্রায় দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারিত একটি সীমার মধ্যে ধরে রাখলেও বাস্তবে কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকদের ১১৭ থেকে ১২০ টাকায় ডলার কিনতে হয়েছে। ব্যাংককে তাদের অতিরিক্ত দাম পরিশোধ করতে হতো ভিন্ন পন্থায়। এখন ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হওয়ায় ভিন্ন পন্থায় আর বেশি দাম পরিশোধ করতে হবে না। ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধি আপাতত তাদের খুব বেশি চাপে ফেলবে না। তবে ব্যাংকগুলো ডলারের দাম নির্ধারণের নতুন ব্যবস্থা কীভাবে কার্যকর করছে, তার ওপর নির্ভর করবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।

বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ও ঋণের সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণের শর্ত পালনের অংশ হিসেবে ডলারের দাম ১১০ থেকে একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি ঋণের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা 'সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল'ভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি বাতিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে নীতি সুদহার। তবে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, সুদ বাজারভিত্তিক হলেও তা যেন বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি না বাড়ে। গত মাসে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। একবারে ডলারের বড় মূল্যবৃদ্ধির সুফল অবশ্য দ্রম্নতই পাবেন রপ্তানিকারকরা। যদি ব্যবসার খরচ নতুন করে আর না বাড়ে তাহলে ডলারের বাড়তি দামের সুবিধা রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেক বাড়িয়ে দেবে। তাতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতি লাভবান হবে। নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানি আয় যেমন বাড়বে, তেমনি বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধিরও বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এত দিন তারা কাঁচামাল আমদানিতে ১১৭-১১৮ টাকার কমে ডলার কিনতে পারছিলেন না। নতুন সিদ্ধান্তে যদি ডলারের কার্যকর দাম এটিই থাকে, তাহলে আমাদের আমদানি খরচ খুব বেশি বাড়বে না। তবে এ সিদ্ধান্তে যদি ব্যবসার অন্যান্য খরচ বাড়ে তাহলে হয়তো কিছুটা চাপ তৈরি হবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ঋণের সুদ বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত ব্যবসার ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা বুঝতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। বিষয়টি নির্ভর করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কীভাবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে, তার ওপর। ডলার-সংকটের এ সময়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লে তা সংকট কাটাতে কাজে লাগবে। ডলারের দাম এক লাফে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। তাতে বিদু্যৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ চাপ মোকাবিলায় সরকারকে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ডলারের দাম বাড়ানোর ফলে বাড়তি যে রাজস্ব আদায় হবে, তা থেকে জ্বালানি আমদানির বাড়তি খরচ সমন্বয় করা যেতে পারে। সেটি করা গেলে বিদু্যৎ-জ্বালানির দাম না বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে।

ডলারের দামে বড় বৃদ্ধি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে। এ ছাড়া মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, বাংলাদেশ থেকে মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এখন কম অর্থ পাবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ডলার-সংকটের কারণে বিমান পরিবহণ সংস্থার অর্থ এবং বিদেশি বহুজাতিক একাধিক কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশ ও মুনাফা লম্বা সময় ধরে আটকে আছে। এসব অর্থ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বেশি দামে ডলার কিনতে হবে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আয় কমবে। গত এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিভিন্ন বিমান পরিবহণ সংস্থার প্রায় ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বাংলাদেশে আটকে রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এ অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশে নিতে পারছে না বৈশ্বিক বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলো। এখন এ অর্থ নিতে বেশি দামে ডলার কিনতে হবে তাদের। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বড় সুবিধা দেবে রপ্তানিকারকদের। যদি ব্যবসার অন্যান্য খরচ না বাড়ে, তাহলে প্রতি ডলারে ৬ থেকে ৭ টাকা বেশি আয় হবে রপ্তানিকারকদের। এতে তাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে। বর্তমানে বিশ্ববাজারের যে পরিস্থিতি তাতে ডলারের এ মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের সক্ষমতা বাড়াবে। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যদি পরিবহণ, বিদু্যৎ ও জ্বালানি খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রপ্তানিকারকরা এর সুফল পাবেন না। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্যবসার অন্যান্য খরচ যাতে না বাড়ে, সে জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

এতদিন প্রবাসী আয়ের ডলার নিজেদের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে আনতে সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলো নিজস্ব উদ্যোগে বাড়তি আড়াই শতাংশ অর্থ দিয়ে আসছিল। এখন ডলারের দাম নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ায় নিজেদের দেওয়া প্রণোদনা বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। প্রবাসী আয়ে বর্তমানে প্রতি ডলারে ১২০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো বাড়তি প্রণোদনা অব্যাহত রাখলে ডলার ১২৩ টাকায় উঠত। ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে 'ক্রলিং পেগ' পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। আগে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ছিল ১১০ টাকা। এখন বিদেশি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবাসী আয়ের ডলারের দাম ১১৭ থেকে ১১৭ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে স্থির করেছে। এর সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ পাশাপাশি ব্যাংকের সমপরিমাণ প্রণোদনা যুক্ত করলে ডলারের দাম হতো ১২৩ টাকা। গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথসভায় সরকারের পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের কিছু ব্যাংক বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে। তবে এতেও প্রবাসী আয়ে খুব বেশি উন্নতি হয়নি। নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর ব্যাংকগুলো প্রণোদনা দেওয়া বন্ধ করেছে। কারণ, সরকারি প্রণোদনা পেলেই ডলারের দাম ১২০ টাকার কাছাকাছি হয়ে যায়। ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেবে। গত এপ্রিল মাসে দেশে ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এর আগে মার্চে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১০ কোটি ডলার ও ফেব্রম্নয়ারিতে ২১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল।

ডলারের দামের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ায় ব্যাংকগুলোকে নিজেদের দেওয়া প্রণোদনা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। সরকারি প্রণোদনা বহাল থাকবে। এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। ডলারের বড় মূল্যবৃদ্ধির সুফল পেতে সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে