পাঠক মত

গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০

ভূঁইয়া শফি সরিষাবাড়ী, জামালপুর
বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে কতগুলো গ্রহ রয়েছে তার সঠিক হিসাব বিজ্ঞান এখনো দিতে পারেনি! তবে আমাদের জানা মতে, এই মহাজগতের কোটি কোটি গ্রহের মাঝে শুধুমাত্র পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। এর কারণ পৃথিবী সূর্যের এমন একটি দূরত্বে অবস্থিত যেখানে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা জীবকুল বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া পৃথিবীর ভূত্বকের ওপরে যে নরম আবরণ রূপে মাটি গড়ে উঠেছে তা জীবজগতের ধারক ও বাহক। জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ও পরিবেশ দুটোই রয়েছে পৃথিবীতে। আবর্তন গতির জন্য পৃথিবীতে যে পর্যায়ক্রমিক দিনরাত্রি ঘটে তা উষ্ণতার ভারসাম্যতা বজায় রাখে, যা প্রাণসঞ্চার এর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। পৃথিবীর প্রাণের উৎস পৃথিবীর চারদিকে বেষ্টন করে থাকা বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন গ্যাসের প্রাধান্য। আর এই অক্সিজেন আমরা (মানব জাতি) আমাদের প্রিয় উপকারী বন্ধু গাছ থেকে পেয়ে থাকি। গাছ আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছপালা এবং গাছের কারণেই আমরা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পেরেছি। বিকাশ হচ্ছে মানব সভ্যতার। গাছ শুধুমাত্র আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন নয়। গাছ অক্সিজেন ত্যাগ করে বলেই মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী বেঁচে থাকে। গাছ আমাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেয়। অনেক গাছে ফল ধরে যা পাখি ও অন্যান্য প্রাণী খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মানুষও বিভিন্ন ফল যেমন- আম, আপেল এবং কলাসহ বিভিন্ন ফলের স্বাদ গ্রহণ করে। গাছের পাতা ও বাকল ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। গাছ পশুপাখি ও মানুষকে আশ্রয় দেয়। বিশাল ঘনগাছ ও গাছ-পালা ভরা অরণ্য বন্যপ্রাণী ও পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে এবং সমৃদ্ধ জীব-বৈচিত্র্যের দিকে অবদান রাখে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো অক্সিজেন। আমরা এই অক্সিজেন গাছ থেকে পেয়ে থাকি এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করি। এই বিষাক্ত গ্যাস যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক তা আবার গাছ গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। গাছ শুধুমাত্র কার্বন ডাই অক্সাইড শ্বাস নেয় তা নয় বরং পরিবেশের ক্ষতিকারক গ্যাস যেমন কার্বন মনোক্সাইড এবং সালফার অক্সাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইড শোষণ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ু শুদ্ধ থাকে এবং পরিবেশ শুদ্ধ হয়। গাছ আমাদের এত উপকার করছে, আর আমরা মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে গাছ নিধন ও বন উজাড় করছি। বনাঞ্চলের গাছ নিধন ও বন উজাড় করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প কারখানা, বিভিন্ন স্থাপনা। হঁ্যা দেশ তথা রাষ্ট্রের উন্নতির স্বার্থে বিভিন্ন কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রয়োজন। কিন্তু আমরা যে হারে বনাঞ্চল ধ্বংস করছি তা বিশ্ববাসীর জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে। বনাঞ্চল জলবায়ুকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয়, তখন আর্দ্রতার হ্রাস পায়, যার ফলে বাকি কোনো গাছপালা শুকিয়ে যায়। বনাঞ্চল উজাড় ও ধ্বংসের কারণে জলবায়ুর ভারসাম্যহীনতা এবং পরিবর্তন বনাঞ্চল জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। গাছ গেস্নাবাল ওয়ার্মিং নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বনের গাছপালা বায়ুমন্ডলে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে গ্রিন হাউজ গ্যাস গ্রহণ করে। গাছগুলো কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করতে সহায়তা করে। আমাদের স্থানীয় জলচক্রের জন্যও গাছ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প ফিরিয়ে দেয়। বৃষ্টিপাতের জল মাটির মধ্য দিয়ে প্রবেশের ফলে মাটি আর্দ্র থাকে এবং বৃষ্টির পানি মাটিতে জমা হয়ে থাকে যার ফলে আমরা নলকূপের মাধ্যমে সেই পানি মাটির নিচ থেকে তুলতে পারি। নদীর কাছে ও তীরবর্তী এলাকা গাছ না থাকলে প্রায়শই ভাঙন দেখা দেয়। নদীর স্রোত টেনে নিয়ে যায় মানুষের আবাসস্থল, বাড়ি, বসতি। বন উড়াড়ের ফলে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী তাদের আবাসস্থল হারায় এবং ফলে অনেকাংশে দেখা যায় বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্ত হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষ যেভাবে বন উজাড় ও গাছ নিধন করছে এতে বর্তমানে সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের মৌসুমি জলবায়ুতে বেশ বড় প্রভাব ফেলছে। আমাদের দেশের অনেক জেলায় অনাবৃষ্টি দেখা দিয়েছে। গ্রিন হাউজ গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে; ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা মতে, গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসারণের কারণে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া ক্রমাগণ চলতে থাকলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলশ্রম্নতিতে মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১.৫ মিটারের অধিক হলে নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিউল, বেইজিংয়ের মতো উপকূলীয় শহর, দ্বীপরাষ্ট্রগুলো যেমন- মালদ্বীপ, টোকিও শহরসহ উপকূলবর্তী অনেক এলাকা সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। আশঙ্কার তালিকায় বাংলাদেশেরও অনেক জেলা শহর রয়েছে যা সমুদ্রের নিচে চলে যেতে পারে। বাংলাদেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ২৫ লাখ ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর বা প্রায় ২৬ লাখ হেক্টর। যা মোট আয়তনের ১৭.৮ শতাংশ। একটি দেশের জন্য স্বাভাবিক বনভূমির প্রয়োজন ওই দেশের আয়তনের ২৫ শতাংশ। আমাদের দেশের বনভূমির পরিমাণ এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় ঘাটতি। এই কমের মাঝেও আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখতে পাই 'বন উড়াজ করা হচ্ছে'। 'সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কাঠুরিয়া ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে বিভিন্ন বনের গাছ কাটা হচ্ছে'। এমনিতেই দেশের বনভূমির পরিমাণ কম এর মধ্যে যদি গাছ কেটে বন উজাড় করা হয় তাহলে দেশের ও পৃথিবীর জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব ফেলার কারণে উপকোলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিজড়, সাইক্লোনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। তাছাড়া জলবায়ুতে প্রভাব ফেলার কারণে অতি বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি দেখা দেবে। ফলে যেসব অঞ্চলে অতিবৃষ্টি হবে সেসব অঞ্চলে বন্যার কারণে চাষাবাদ সম্ভব হবে না। আবার যেসব অঞ্চলে অনাবৃষ্টি দেখা দিবে সেই অঞ্চলে খরা হবে। ফলে সেখানেও চাষাবাদ সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই এ দেশের মানুষের আয়ের উৎস। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজ করেন। যদি বন্যা ও খরার কারণে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দেশের মানুষ অনাহারে মারা যাবে। আমাদের দেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বন উজাড় করা হচ্ছে এ নিয়ে বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইতোমধ্যেই। আবার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনভূমি হলো আমাজন। পৃথিবীর জন্য আমাজন অরণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন। এই কারণেই আমাজনকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, আমাজনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে যা প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতিতে বিভক্ত। আমাজনে যে বিলিয়ন বিলিয়ন গাছ রয়েছে, সেসব গাছ কেউ লাগিয়ে দিয়ে আসেনি বরং প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে সবুজ অরণ্যে। আমরা যদি গাছ না লাগাই তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আমাদের প্রকৃতিকে গোছানোর সুযোগ দিতে হবে। গাছ ও বনাঞ্চলকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। গাছকাটা বন্ধ হলে প্রকৃতিই নিজে নিজেকে সাজিয়ে নেবে। আর যদি আমরা নির্বিচারে গাছ কাটতে থাকি তাহলে প্রকৃতি একদিন আমাদের থেকে সেই বদলা নেবে। তাই 'পৃথিবীকে বাঁচাতে গাছকাটা বন্ধ করতে হবে'।