হায়দার আকবর খান রনো একজন নির্মোহ স্বচ্ছ রাজনীতিকের প্রয়াণ

মানুষের কল্যাণে তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিলো গণমানুষের মুক্তি। এ দেশের শোষিক বঞ্চিত পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতি তার ছিল অন্যরকম দরদ ও ভালোবাসা। লোভের দুনিয়ায় তিনি ছিলেন ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল এক নির্লোভ তারকা।

প্রকাশ | ১৩ মে ২০২৪, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
কাছের ও প্রিয় মানুষ যদি সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে যান, সঙ্গত কারণেই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বিষাদে শোকে মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নীতি-আদর্শের দিক থেকে যদি হয় সমমনা অথবা খুব কাছাকাছি তা হলে মন স্বাভাবিক হতে সময় লাগে, জেগে ওঠে উজ্জ্বল স্মৃতির পাহাড়। তার জীবনের নানা ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণামূলক দিক। যার কথা বলছি, তিনি একজন নির্মোহ স্বচ্ছ প্রবীণ রাজনীতিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনো। তিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, সাহিত্য-সংস্কৃতির দিশারি ও লেখক। রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা লেখক, তাদের অধিকাংশই রাজনীতি বিষয়ে লিখে থাকেন। রনো ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। কেবল বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের ওপর তার দখল ছিল। তার সাহিত্যবিষয়ক গদ্য, যে কোনো সাহিত্যের লেখকের চেয়ে উজ্জ্বল। তিনি বরীন্দ্রনাথ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর যে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন, তা পাঠান্তে আমি অবাক হয়েছি। যার কারণে তার প্রতি আগ্রহ ছিল একটু বেশি। ১৯৯৯ সালে বস্তিনির্ভর ও বস্তির জীবন নিয়ে আমার যে উপন্যাস জন্মদৌড় প্রকাশিত হয়, তার এক কপি তার হাতে তুলে দিয়ে বলি, রনো ভাই, আপনি যদি উপন্যাসটির ওপর কিছু লিখতেন। তিনি সরল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, বললেন, আমি কি পারব? একদিন আজকের কাগজ অফিসে এসে আমাকে লেখাটি দিলেন। আমি যারপরনাই খুশি হলাম। এখানে উলেস্নখ করা প্রয়োজন, এ উপন্যাসের ওপর মমতাজউদদীন আহমদ, কবি আবুবকর সিদ্দিক, অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ, কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত, আতা সরকার লিখেছেন, যা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। রনো ভাই আমার অনুপ্রেরণা ও অনুরোধে আজকের কাগজে নিয়মিত কলাম লিখতেন এবং লেখা হাতে করে অফিসে আসতেন আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারার জন্য। তিনি আজকের কাগজের নিয়মিত গোলটেবিল বৈঠকেও একাধিকবার উপস্থিত হয়েছিলেন। আজকের কাগজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি ২০০৮ সালে যায়যায়দিনে যোগ দিই। আমার অনুরোধে যায়যায়দিনেও তিনি কলাম লিখতেন। বিজয় সরণির সামরিক জাদুঘরের এ্যানট্রান্স রেস্তোরাঁয় যে কটা বড় অনুষ্ঠান করেছি আমার জন্মদিন উপলক্ষে, উপস্থিত থেকেছেন সেখানেও। বক্তব্য দিয়েছেন জন্মদৌড় উপন্যাসের ওপর। বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, দেশের খ্যাতিমান লেখক রাজনীতিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। এ দেশের লোভী রাজনীতির পরিবৃত্তে নিজেকে কখনো জড়াননি। ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি করে কোনো সুবিধাও নেন নি। অথচ এ ক্ষেত্রে তার সুযোগ ছিলো অবারিত। মানুষের কল্যাণে তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল গণমানুষের মুক্তি। এ দেশের শোষিক বঞ্চিত পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতি তার ছিল অন্যরকম দরদ ও ভালোবাসা। লোভের দুনিয়ায় তিনি ছিলেন ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল এক নির্লোভ তারকা। \হমাস কয়েক আগে তাকে ফোন করেছিলাম। তিনি ফোন পেয়ে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তিনি বের হন না। কারণ অক্সিজেন ছাড়া তিনি চলতে পারতেন না। তিনি ১১ মে ২০২৪ হাসপাতালে চিকিৎসধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তার জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায়। তার পৈতৃক নিবাস নড়াইলের বরাশুলা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকলেও ২০১০ সালে মতভিন্নতার কারণে এই দলটি ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এরপর তিনি সিপিবির উপদেষ্টা হন। মার্কসবাদী রাজনীতির ওপর বেশ কটি বই লিখেছেন তিনি। মার্ক্সসবাদী দর্শন ও তত্ত্বের ওপর তার বিভিন্ন বই রয়েছে। তেমনি তার বই রয়েছে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের ওপরও। বাংলাদেশে প্রগতিশীল তথা মার্কসবাদ বিষয়ক বই লেখার ক্ষেতে তার জুড়ি মেলা ভার। অথচ বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ তাকে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ন করেনি। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩। তিনি শতাব্দী পেরিয়ে বইয়ের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। মানবিকতা, সাম্যবাদ ও বাঙালি মানসিকতার বিবর্তনের রূপরেখা তার লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবনেও কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতিফলন দেখা যায়। এসব বিষয়ে তার ছিল সরব পদচারণা। তিনি যে নীতি আদর্শে বিশ্বাস করতেন, তাতে তিনি সব সময় অটল থেকেছেন আমৃতু্য। রাজনীতির বক্তৃতার ক্ষেত্রে যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতাতেও তিনি সামনের সারি দখল করে রেখেছিলেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তিতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। রনো ভাই ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রনো ভাইয়ের অবদান ছিল অতুলনীয়। পরবর্তী সময়ে জিয়া-এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন, বিএনপি-জামায়াত মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন- সব ক্ষেত্রেই রনো ভাই ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। এ দেশের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলন এবং ইতিহাসের বাঁক বদলের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও অবদান জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখবে। তার নানা কর্মকান্ড উদারনৈতিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানে। কারণ ব্যক্তিকে অবলম্বন করে ব্যক্তিসত্তার বাইরে তিনি আলাদা জগৎ তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন সত্য, জ্ঞান, নীতি ও প্রজ্ঞার সাধক। জাতির অন্যতম অভিভাবক ছিলেন তিনি। ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। মৌলবাদ-সাম্প্র্রদায়িকতা ও কূপমন্ডূকতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দীর্ঘদিন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতির ভেতরের শুভ শক্তিগুলো তিনি আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, শনাক্ত করেছেন, এটা যদি আমরা অনুসরণ করতে পারি তার আদর্শের পথে, তা হলে আগামী প্রজন্মও অনুপ্রাণিত হবে। তিনি আজ দূর আকাশে মিলিয়ে গেছেন। তিনি তার জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে যে অবদান রেখে গেছেন তা স্মরণীয় ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। এই গুণী ও আলোকিত মানুষটির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক