টেকসই উন্নয়নে রাজস্ব বৃদ্ধির বিকল্প নেই

সরকারি আয় বৃদ্ধির তাগিদ, আয় বণ্টনে ন্যায্যতা বিধান, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া সরকারি ব্যয় নির্বাহ এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ইসু্যটি এখন বাংলাদেশের সামনে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

প্রকাশ | ১১ মে ২০২৪, ০০:০০

রেজাউল করিম খোকন

সামন্ত রাজাদের আমল থেকে রাজস্ব সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার প্রচলন আছে। সামন্ত রাজারা রাজস্ব আদায় করত, তখন থেকেই একটা নেতিবাচক ধারণা চলে আসছে। আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে যে, রাজস্ব দেওয়া মানেই রাজার অত্যাচার, রাজার জুলুম। সামন্ত রাজাদের সময়ে রাজার দায়িত্ব ছিল রাজ্য রক্ষা করা ও প্রজাদের রক্ষা করা। তাদের অর্থের উৎস ছিল ভূমিকর এবং বাণিজ্য কর। আধুনিক রাষ্ট্রের চিন্তা হলো, ওই দু'টি ছাড়াও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, জনগণের আয় বৃদ্ধি করা এবং সবার আর্থিক উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশের উন্নয়ন করা এবং দেশকে পৃথিবীর মধ্যে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করা। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব যেমন বেশি, তেমনি, রাজস্ব বাড়ানোর দায়িত্বও বেশি। আর্থিক খাতে মধ্যমেয়াদি সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ ৪৯ ট্রিলিয়ন বা ৪৯ লাখ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে। আর্থিক খাত টেকসই করতে করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা করে করছাড় বাদ দিতে হবে। এতে ৪ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা যাবে। বর্তমানে কর জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি সবচেয়ে কম। আমাদের কর জিডিপির হার সোমালিয়া বা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি। সংস্কার না করা হলে আগামী বছরে এই হার আরও কমবে। আর ১০ শতাংশের কম কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণ সম্ভব নয়। দেশে কর-জিডিপির অনুপাত হতাশাজনক; কর জিডিপি নিয়ে সোমালিয়া কঙ্গোর সঙ্গে তুলনা করাটাও ঠিক নয়। সে সব দেশের সঙ্গে তুলনা করলে সবকটি মানদন্ড নিয়ে তুলনা করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যাদের কর জিডিপি হার বেশি, তাদের রাজস্ব আয়ের উৎস দেখতে হবে। যেমন মালদ্বীপের কর-জিডিপির হার বেশি। সেখানে রাজস্ব আদায়ের মূল উৎস পর্যটন খাত। আমাদের কিন্তু এমন উৎস নেই। গত পাঁচ বছরে ১২০ ধরনের করছাড় দিয়েছে সরকার। এভাবে ব্যবসা ও শিল্পে সুবিধার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে করছাড় দেওয়া হচ্ছে। তবে দীর্ঘদিন, ২৫ বছর ধরে এমন সুবিধা থাকা উচিত নয়। ধারাবাহিকভাবে সরকারের খরচের সঙ্গে ধারের পরিমাণ বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করা হয় তার পুরোটাই ধার করে করা হয়। গত ১৫ বছর বা তার বেশি সময় সরকারের কোনো সেভিংস নেই- যা মোটেও ভালো বিষয় নয়। কর আহরণের বড় সমস্যা হচ্ছে সরাসরি আদায় কম। মোট করের মাত্র এক তৃতীয়াংশ আদায় হয় সরাসরি। বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করা হয় তার পুরোটাই ধার করে করা। সরকারের খরচের সঙ্গে এই ধারের পরিমাণ বাড়ছে- যা ভালো বিষয় নয়। অর্থ ধার নেগেটিভ নয়, এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভালো। জাতীয় রাজস্বের ৪৩ শতাংশ চলে যায় বেতন, ভাতা ও পেনশনে- যা অনেক বেড়েছে। মাথাপিছু আয়ের তুলনায় দেশে রাজস্ব আদায় যে পরিমাণ কম হয়, তা অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। বলা যায়, বাংলাদেশ যে রাজস্ব আদায় করে তা পৃথিবীর সবচেয়ে কম। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এত কম রাজস্ব আদায় দেখা যায় না। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার ৯৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান ভ্যাট আইনে এটি ২৯ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে না। যদি সিস্টেম পরিবর্তন করা যায়, তাহলে তা ৭৮ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব প্রয়োজনীয় খাতে যেভাবে খরচ কমানো হয়েছে, তা কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হবে। ২০১২ সালের ভ্যাট আইনটি ঠিক ছিল। এখন যেটা আছে তাতে একাধিক পর্যায়ে একসেস ডিউটি রয়েছে- যা বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতি করছে। তাই ২০১২ সালের ভ্যাট আইনে ফিরে যাওয়া দরকার। তখন ভ্যাট সিস্টেম পুরোপুরি কাজ করবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে চাইলে রাজস্ব আদায়ের হার ও কর দ্রম্নত বাড়াতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের আয়কর আদায়ের হার ছিল শতকরা মাত্র ১০ ভাগ। বাকি ৯০ ভাগ রাজস্ব আসত কাস্টমস থেকে। কাস্টমস থেকে রাজস্বের হার ১৯৯১-৯২ সালে ৫৪ শতাংশে নেমে আসে, ভ্যাট থেকে ২৫ শতাংশ ও আয়কর থেকে ২১ শতাংশ। ২০১১-১২ সালে কাস্টমস থেকে রাজস্ব আদায় ৪০ শতাংশ, ভ্যাট থেকে ৩০ শতাংশ এবং ইনকাম ট্যাক্স থেকে ২৭ শতাংশ আদায় হয়েছে। ২০২১-২২ এ কাস্টমসের আদায় এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশ, আয়করের ৩৪ শতাংশ এবং ৩৭ শতাংশ ভ্যাট। দেখা যাচ্ছে, কাস্টমস থেকে রাজস্ব আয় ধীরে ধীরে কমছে এবং ইনকাম ট্যাক্স এবং ভ্যাট বাড়ছে। ১৯৭২-৭৩ এ আমাদের আর্থিক অবস্থা ছিল কৃষিনির্ভর। তখন কোনো ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রি বেড়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে মানে কর দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ছে, দেশের উন্নতি হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বাজেট ২০০৮ সাল থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৭ গুণ বেড়েছে, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের হার গত ১০ বছরে ৪ গুণ বেড়েছে। আমরা যেহেতু খুব দ্রম্নত উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই, কাজেই এই রাজস্ব আদায়ের হার যথেষ্ট নয়। আমাদের এটা আরও বাড়াতে হবে। রাজস্ব দিতে জনগণের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারি শিল্পের উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি মেড ইন বাংলাদেশ বা 'বাংলাদেশে তৈরি' ধারণার বিকাশ করা হবে। বাজারে যখন যাই, দেখতে পাই, সব পণ্য মেড ইন চায়না, মেড ইন মালয়শিয়া, মেড ইন থাইল্যান্ড, মেড ইন ইন্দোনেশিয়া। আমাদের মার্কেটকে পুঁজি করে অন্য দেশ তাদের জিডিপি উন্নত করছে। এটা হতে দেওয়া যায় না। আমাদের বাজারে শুধু আমাদের পণ্য থাকবে। ২০২০ সালে নেওয়া মেড ইন বাংলাদেশ কনসেপ্ট হলো, আমরা চাই যে মধ্যবিত্তের ব্যবহার্য পণ্যগুলো বাংলাদেশে তৈরি করা হোক। মেড ইন বাংলাদেশ কনসেপ্টের ফলে স্মার্টফোন, টেলিভিশন, এসি, মোটর সাইকেল শতকরা ৯৫ ভাগ পণ্য এখন বাংলাদেশে তৈরি। আমাদের ভারি ও নতুন শিল্প দরকার। আমরা উন্নত দেশ হব, কিন্তু অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল, বালতি, পস্নাস্টিকের বদনা বানাব আর বাইরের মানুষের কাপড় সেলাই করব। এই দিয়ে তো উন্নত দেশ হতে পারব না। উন্নত দেশ হতে হলে ভারী শিল্প তৈরিতে ঝুঁকতে হবে। ভারী শিল্প কঠিন কিছু না, যেটা আমাদের দেশের মানুষ পারবে না। টেকসই উন্নয়নে রাজস্ব বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কিছু বিষয়ে কর ছাড় বাদ দিলে ৪ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা আয় সম্ভব। ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন না হলে ২০৪১ সালের মধ্যে রাজস্ব ক্ষতি হবে ৫০ লাখ কোটি বা ৫০ ট্রিলিয়ন টাকা। এছাড়া সংস্কারের পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে করছাড় বাদ দিলে আগামী চার বছরে ৬০ হাজার কোটি বা ৬০০ বিলিয়ন টাকা আয় করা সম্ভব। এজন্য টেকসই উন্নয়ন করতে হলে করব্যবস্থা সংস্কারের বিকল্প নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ যেহেতু উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চায় সেহেতু এসব কার্যক্রম না করলে দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য অটোমেশনের বিকল্প নেই। বর্তমানে সবাই অনলাইনে রিটার্ন সাবমিট করতে পারেন। দেশের ইনফরমাল সেক্টর অনেক বড় বিধায় এ খাত থেকে কর আদায় গুরুত্বপূর্ণ। তাই কর প্রশাসন, কর আদায় ব্যবস্থা সংস্কার, সুশাসন নিশ্চিত এবং অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতেই হবে। এখন কর যা আদায় হয় তার ৪৩ শতাংশই চলে যায় বেতন, ভাতার টাকা পরিশোধে। এছাড়া সরকার যে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা পূরণ করতে হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ঋণ সংকুচিত হয়ে পড়ে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের রাজস্ব জিডিপির শতাংশ হিসাবে বিশ্বের সর্বনিম্ন। এত দুর্বল রাজস্ব আদায় স্বল্প মেয়াদে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং মধ্য মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা-২০৪১কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলে দেশের রাজস্ব আহরণ ভারত ও কম্বোডিয়ার কাছাকাছি দাঁড়াবে। কিন্তু রাজস্ব সংস্কার পদক্ষেপ বাণিজ্য করের ওপর নির্ভর করলে হবে না। কারণ, বাণিজ্য কর রপ্তানি বৃদ্ধি ও রপ্তানি বহুমুখীকরণকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে আগামীতে কর যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। যদি দেশীয় কর রাজস্ব জিডিপির ২ শতাংশ বাড়ানো যায় তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বর্তমান স্তরের ওপর শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে। বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, সেবা খাতমূলক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এবং সেবাগ্রহণকারী ও সেবাপ্রদানকারী মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন সেবা (আইটি এনাবল্ড সার্ভিস) প্রদান করছে- যা ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশে এ ধরনের সেবা, বিশেষভাবে খুচরা ব্যবসা খাতে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। নিকট অতীতে ইন্টারনেট সেবার সম্প্রসারণে সরকার ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ডিজিটাল অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ (যেমন আইটি পার্ক প্রতিষ্ঠা) ও নীতি সহায়তা ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ খাতের ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের সক্রিয় ভূমিকা ও অবদান। গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স, ইউটিউবসহ বিভিন্ন বহুজাতিক ও বৈশ্বিক পস্ন্যাটফর্মগুলো তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি খাতের পরিধিকে আরও ব্যাপকতা ও গভীরতা দিয়েছে। ই-কমার্সের ওপর আরোপিত মূসক (ভ্যাট) নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অবশ্য তর্কবিতর্ক হয়েছে। ৫ শতাংশ মূসক আরোপের পর তা আবার পরবর্তী সময়ে প্রত্যাহারের উদাহরণও আছে। মূসকের ভিত্তি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। দ্বৈত করারোপের আশঙ্কা থেকে যায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের ভৌত ও অনলাইন দুই ধরনের কার্যক্রমই আছে, তাদের জন্য প্রযোজ্য কর কী হবে, এসব বিষয়ে স্পষ্টতার অভাবের কারণে কর আদায়কারী সংস্থা ও কর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। কর আইনে এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। অনাবাসিক (নন-রেসিডেন্ট) কোম্পানিগুলো দ্বারা প্রদেয় কর নিয়েও জটিলতা রয়েছে। ইউটিউব, গুগল, ফেসবুক জাতীয় বৈশ্বিক পস্ন্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশীয় কোম্পানি ক্রীত সেবার (যেমন বিজ্ঞাপন সেবা) ওপর ১৫ শতাংশ মূসক আদায়ের বিধান রয়েছে এবং এসব কোম্পানি কর্তৃক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (বিন) নেওয়ার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এ পর্যন্ত এ ধরনের নয়টি কোম্পানি 'বিন' নিয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, এসব কোম্পানির বাংলাদেশে কর জমা দিতে হয় না, যেহেতু বর্তমানে তাদের ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিন) গ্রহণের বিধান নেই। এসব কোম্পানি অন্য দেশে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিয়ে থাকে (অনেক ক্ষেত্রে ট্যাক্স হেভেনগুলো)। ফলে এসব কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করে যে লাভ করে, তার ওপর করারোপের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের সুযোগ থেকে সরকার বঞ্চিত হয়। এটি একটা বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। আইটি এনাবল্ড ২৮টি খাতের ওপর থেকে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হলে এবং বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের ওপর কর আরোপ করা হলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। বাংলাদেশ এ কারণে বছরে অন্তত ৩৫০ কোটি টাকার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ই-কমার্স খাত ও তার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে এ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের কথাও ভাবতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। এ খাতের বিকাশ ও রাজস্ব আদায়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে ডিজিটাল অর্থনীতিকে রাজস্ব আদায়ের কৌশলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কর আদায় ও কর ব্যবস্থাপনার সব পর্যায়ে ডিজিটালাইজেশন চালু করার মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর আহরণ সহজ করতে হবে। ডিজিটাল (ই-কমার্স, এফ-কমার্স) প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের পদ্ধতি প্রমিতকরণ (স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) করতে হবে, যাতে অবচয় বেশি ও লাভ কম প্রদর্শনের মাধ্যমে কর ফাঁকির সুযোগ বন্ধ করা যায়। গুগল, অ্যামাজন, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, ফেসবুকসহ যেসব গেস্নাবাল পস্ন্যাটফর্ম বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, তাদের আয়ের ওপর কর আরোপের ক্ষেত্রে ও.ই.সি.ডি. যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশকে সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। ডিজিটাল অর্থনীতিকে রাজস্ব আদায় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে।

 

এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধি ও যথোপযুক্ত মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাণিজ্য করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম ৩ দশমিক ১ শতাংশ শুল্ক রাজস্বের তুলনায় কম থাকে। এসব দেশ বাণিজ্য করের ওপর নির্ভর করে না। দেশের রাজস্ব ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। যেমন, শুল্কমাত্রা যৌক্তিকীকরণ করার প্রয়োজন। এছাড়া পোশাক খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো অবদান রেখেছে। কিন্তু পোশাক খাতের বাইরে অধিকাংশ রপ্তানি শিল্পই এমন সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে অসহযোগিতামূলক নীতি তৈরি হয়েছে। এদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম এবং মুনাফা বেশি হওয়ায় পোশাক খাতের বাইরে শিল্প রপ্তানিকারকরা রপ্তানি করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। জাতীয় শুল্কনীতির আবদ্ধ সীমাবদ্ধতার কারণে রপ্তানি বহুমুখীকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবহারের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে অনেক কিছুই সহজীকরণ হবে। যেমন, আইবাস সিস্টেম চালু হওয়ায় এখন বাজেট প্রণয়ন সহজ হয়েছে। করছাড় যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ২৫ বছর আগের প্রণোদনা এখনো কেন থাকবে? আমরা কি সন্তানদের ২৫ বছর পর্যন্ত পকেট মানি দেই? রাজস্ব আদায় বাড়াতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে কর সংগ্রহ করতে হবে। আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়ানো দরকার। অর্থনৈতিক কাঠামো এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে এতে কোনো কোনো জায়গায় ক¤েপ্রামাইজ করতে হয়। সুদহার ব্যাংক রেটের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। করনীতি এবং সংগ্রহ দু’টিকে আলাদা করা দরকার। এক্ষেত্রে রাজস্ব প্রতিষ্ঠানে যারা আছেন তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত নিয়ে হতাশার কিছু নেই। মালদ্বীপ, নেপালসহ অনেক দেশ বেশি কর আদায় করতে পারে কারণ, তাদের মূল উৎস পর্যটন খাত। সেখানে অনেক বেশি কর বসানো যায়। তাই এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক দেশের তুলনায় আমরা এগিয়ে আছি। মনে রাখতে হবে সরকার যত বেশি ঋণ নেবে তত বেশি কার্যক্রম বাড়বে। রাজস্বও বেশি আদায় হবে। তাই ঋণ বিষয়ে হতাশার কিছু নেই। এনবিআরে অটোমেশনের কাজ চলছে। এতে কর জিডিপি রেশিও অবশ্যই বাড়বে। ইতোমধ্যে টিআইএনধারীর সংখ্যা বেড়ে ১ কোটি ২০ লাখ হয়েছে। এর মধ্যে রিটার্ন দেওয়া বেড়ে হয়েছে ৩৯ লাখ। ভ্যাট প্রদানকারী ২ লাখ থেকে বেড়ে ৫ লাখে উন্নীত হয়েছে। তবে কর ছাড়ের জন্য অনেক বড় তদবির আছে আমাদের কাছে। সবার সবকিছুই সহ্য হয় কিন্তু করের লোড নিতে পারে না। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যারা কর দিচ্ছেন শুধু তাদেরই চাপ দেওয়া হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ভয়ংকর, যারা অনেক বেশি ব্যবসা করছে। কিন্তু কর দেয় না। এখন শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। গ্রামগঞ্জে যেতে হবে। সেখানে মানুষ অনেক  আয় করে। কর আদায় দুর্ভোগমুক্ত করতে হবে। 
সরকারি আয় বৃদ্ধির তাগিদ, আয় বণ্টনে ন্যায্যতা বিধান, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া সরকারি ব্যয় নির্বাহ এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ইস্যুটি এখন বাংলাদেশের সামনে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে।
 জিডিপির শতাংশে বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক নিচে। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলঙ্কাকে বাদ রাখলে সর্বনিম্ন। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ নিশ্চিত করার মাধ্যমে কর ও করবহিভর্‚ত আয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব ফাঁকির পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। তা না হলে রাজস্ব খাতে উদ্বৃত্ত আয় (রাজস্ব আয় ও রাজস্ব ব্যয়ের পার্থক্য) নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না এবং উন্নয়ন বাজেটের সম্পূর্ণটাই ঋণনির্ভর অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল থেকে যাবে। রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও ঋণ পরিষেবার চাপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আদায়কৃত রাজস্ব আয়ের ক্রমবর্ধমান অংশ ঋণ পরিষেবায় (সুদ ও আসল) ব্যয়িত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের জন্য ঋণের ফাঁদে পড়ার একটি আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। তাই এখনই সময় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় অগ্রাধিকারে রাখা যেতে পারে। এগুলো হলো, করভিত্তির সম্প্রসারণ, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ডিজিটালাইজেশন ও আধুনিকায়ন, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে আইনি প্রয়োগ নিশ্চিত করা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। দেশের আর্থিক খাতের উন্নতি করতে হলে আরও সময় লাগবে। আর্থিক খাতের ভালো করতে যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার, সেগুলো এখন নিলেও কাজে আসতে অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। যেটা আইএমএফও জানে। যেসব ব্যবসা এনবিআর’র রাজস্ব আহরণের বাইরে আছে, তারা অনেক ভয়ংকর। তাদের কর আহরণের নিয়মে আনতে হবে। শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর নির্ভর করলে হবে না। ট্যাক্স নীতি ও আহরণের নিয়মে অটোমেশন সিস্টেম চালু করতে হবে। যখন অটোমেশন হবে তখন কর আহরণ বাড়বে। ভ‚মি সেক্টরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য ভ‚মি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন ভ‚মিমন্ত্রী। ভ‚মিমন্ত্রী বলেছেন, গ্রামীণ কিংবা মফস্বলের পতিত কিংবা অনাবাদি জমি, উর্বর কৃষি জমি, আবাসিক, বিলাসবহুল, শিল্প, শহরের বাণিজ্যিক এলাকার জমির ই-নামজারি ফি একই হওয়া উচিত নয়। জমির ব্যবহার ও মূল্যভিত্তিক ই-নামজারি নির্ধারণের আইনি দিক পরীক্ষা করতে হবে। ভ‚মি উন্নয়ন কর ও নামজারি ব্যবস্থা ডিজিটাইজেশনের ফলে ভ‚মি খাতে রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

রেজাউল করিম খোকন :অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক