পাঠক মত
বর্ষীয়ান গাছগুলো রক্ষা করতে হবে
প্রকাশ | ১০ মে ২০২৪, ০০:০০
সুমাইয়া আকতার সরকারি ব্রজমোহন কলেজ বরিশাল
জলবায়ুর পরিবর্তনে পৃথিবী যেন হয়ে উঠছে বসবাসের অনুপোযুক্ত। আর এই জলবায়ুর পরিবর্তনে অন্যতম হুমকি হিসেবে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলো বিশেভাবে উলেস্নখযোগ্য। ফলে পৃথিবীতে অতিবেগুনী রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নিম্নস্তরগুলো তলিয়ে যাচ্ছে, অকালে দুর্যোগ, খরা ও নদী ভাঙনের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। মানুষ বাস্তুচু্যত হচ্ছে। ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। এছাড়াও বায়ুমন্ডলীয় স্তরের পরিবেশ উপযোগী গ্যাসের পরিবর্তে বাড়ছে বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা। প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈচিত্র্যতা হারিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বৈরী পরিস্থিতি। জনজীবন হয়ে উঠছে তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ। যার অন্যতম প্রধান কারণ হল বর্ষীয়ান গাছ নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়া। কালের সাক্ষী হয়ে শত ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে পরিবেশে টিকে থাকা বর্ষীয়ান গাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন অর্থাৎ রাস্তার প্রশ্বস্ততা বৃদ্ধি কিংবা সৌন্দর্যবর্ধনের লক্ষ্যে। যেমনটাই দেখা যায়, বরিশালের সি অ্যান্ড বি রোড সংলগ্ন ঢাকা টু কুয়াকাটা মহাসড়কের বর্তমান দৃশ্যে। বিগত ২০২১ সালে রাস্তায় সর্বমোট চারটি লেন ছিল। যার মাঝখানের দুই লেন মহাসড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং অবশিষ্ট দুই লেন শহরের গাড়ি চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও প্রতিটি রোড ডিভাইডারে ছিল বিরুপ পরিবেশে টিকে থাকা বেশ কিছু বর্ষীয়ন গাছ। ফলে গ্রীষ্মকালের তীব্র দাবদাহেও মিলত স্বস্তির বাতাস এবং থাকত স্বাভাবিক পরিবেশের পরিস্থিতি। এই গাছগুলোর ছায়াতলে আশ্রয় নিতো রাস্তার পথচারী ও স্থানীয়রা। পাখপাখালির কিচিরমিচিরে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া প্রবাহমান ছিল। যা ছিল রাস্তার নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বস্তির নিঃশ্বাসের অংশ। কিন্ত বর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় রাস্তা প্রশ্বস্ত করার জন্য বর্ষীয়ান গাছগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে রোড ডিভাইডারের ভিতর থেকে। ফলে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে শহরের অসহনীয় তাপমাত্রা। বৃষ্টির মৌসুমের আগমন ঘটলেও বৃষ্টি হচ্ছে না, ফসলের ফলনশীল উর্বরতা ও মাটির গুণাগুণ কমে যাচ্ছে। নির্বিচারে গাছগুলো কাটার কারণে প্রকৃতির বিরূপ আবহাওয়ার তৈরি হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর চেয়ে সবচেয়ে বেশি জরুরি বর্ষীয়ান গাছগুলো সংরক্ষণ করার বিধিমালা জারি করা ও বাস্তবায়নে অগ্রগামী হওয়া। তাছাড়া ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেই তুলনায় গাছের সংখ্যা ৯ ভাগেরও কম। পাশাপাশি বর্ষীয়ান গাছগুলোর রক্ষণশীলতার অভাবে পরিবেশ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। মানুষসহ পশুপাখিদের স্বাভাবিক জীবনও বিপর্যস্ততার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। তাছাড়া এসব গাছে নানা রকমের পাখির অভয়ারণ্য বিশেষ করে, টিয়া, ময়না, বুলবুল, বট ঘুঘু, চিঁহি, শালিকসহ নানা রকমের পাখির আবাসস্থল বর্ষীয়ান গাছগুলো। অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পাওয়া যায় এই গাছগুলোর কারণে। কিন্তু সময়ের আবর্তণে এই গাছগুলো সংরক্ষণশীলতার অভাবে হারিয়ে যেতে থাকলে কিংবা নির্বিচারে কাটার কারণে যেকোনো দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া দষ্কর হয়ে উঠবে। তাই দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতেও এই বর্ষীয়ান গাছগুলো সংরক্ষণ করা বর্তমান সময়ের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিদু্যৎ বিভাগ, ওয়াশা, সড়ক ও জনপথকে দেখা যায় বিদু্যতের লাইন টানার নামে কিংবা সড়ক প্রশস্ত করার নামে বর্ষীয়ান গাছগুলো নিধন করছে। এছাড়াও পাহাড় কেটে, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর- দিঘি অবৈদভাবে ভরাট করে ময়লার ভাগাড় ফেলে, দখল করে দালানকোঠাসহ নানা স্থাপনা করেছে অনেকে। পাশাপাশি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নিধন করা হচ্ছে বর্ষীয়ান গাছগুলো। ফলে মানবজাতি পরিবেশের বিরূপ পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হতে চলেছে। বর্ষীয়ান গাছগুলো যেন মানবজাতির মধ্যে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে যুগ যুগ ধরে সেতুবন্ধ রচনা করে চলেছে। গাছ হলো পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ, প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে প্রাচীন বর্ষীয়ান এই বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। একটা গাছ বছরে ১১৮ কেজি অক্সিজেন সরবরাহ করে। বাতাস থেকে শোষণ করে ২৩ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড। একটি গাছ প্রায় দুজন মানুষের অক্সিজেন জোগায়। মনের যত্ন নিতে প্রকৃতির ও বৃক্ষের কাছে ছুটে যেতে হয়। কারণ গাছের সঙ্গে মানব আত্মার যোগাযোগ নিহিত। তাইতো পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ' বইয়ের লেখক আহমদ ছফা বলেছিলেন, 'সবুজ উদ্ভিদের যে একটা আত্মা রয়েছে, তার স্পর্শ আমার নিজের আত্মায় এসে লাগে। মুখে কোনো বাক্য আসতে চায় না। এইখানে ঈশ্বরের এই প্রাচুর্যের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।' শুধু বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করলেই হবে না বরং পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে সবুজের সঙ্গে যে মানব আত্মার অস্তিত্ব রয়েছে তা টিকিয়ে রাখতে হবে। মানুষ এখন যেন প্রকৃতিকেই বাদ দিয়ে চলতে চায়। মানুষ ও প্রকৃতি সহাবস্থানে থাকলেই পৃথিবী হয়ে উঠবে সবুজের সমারোহপূর্ণ ও নিরাপদ। তাই সবুজ অরণ্য ঘেরা পরিবেশ বজায় রাখতে বর্ষীয়ান গাছের যত্ন নেওয়া এবং রক্ষায় স্থানীয় জনগণ ও কর্তৃপক্ষকে বাস্তবমুখী কার্যসম্পাদনে স্বউদ্যেগে অগ্রসর হতে হবে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য হলো মনের দাওয়াই। গাছ হলো পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ, প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রাচীন বর্ষীয়ান এই বৃক্ষগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।