বারবার কেন আগুনে পুড়ছে সুন্দরবন

সুন্দরবনকে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই রক্ষা করতে হবে। অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রকাশ | ০৯ মে ২০২৪, ০০:০০

মো. জিলস্নুর রহমান
বাংলাদেশের ফুসফুস বা হৃৎপিন্ডখ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের মধ্যে কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জেই প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বনে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে প্রতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে বনের সুরক্ষায় তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো থেকে যায় ফাইলবন্দি ও পর্দার আড়ালে। বন বিভাগের হিসাব মতে, কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ২৩ বার লাগা আগুনে পুড়েছে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি। সর্বশেষ ৪ মে ২০২৪ আগুন লাগার ক্ষতির পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুর বুনিয়া এলাকায় আগুনের সূত্রপাত হলে দুই কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো আকাশপথে হেলিকপ্টারে করে পানি ছিটানো হয়। বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনের যে স্থানে আগুন লেগেছে তা লোকালয় থেকে অনেক দূরে এবং এর ধারের কাছে কোনো লোক বসতি নেই। বনের ওই স্থানে বিভিন্ন গাছে মৌচাক আছে এবং মধু সংগ্রহের জন্য সেখানে মৌয়ালদের যাতায়াত রয়েছে। তবে সঠিক কি কারণে আগুন লেগেছে তা তদন্ত করার আগে বলা মুশকিল। তবে এর আগে বনে মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য মশাল থেকেও বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও নানা প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দাবদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, বনাঞ্চলে মানবসৃষ্ট অগ্নিকান্ড- যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘের একটি কমিটির ২০১৪ সালের মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো উঠে আসে? ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশে দাবদাহ, বনাঞ্চলের অগ্নিকান্ড ক্রমাগত বাড়ছে একইভাবে, উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে এবং কিছু দিন পরপরই বিশ্বের নানা জায়গায় একই উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে এগুলো পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২২ বছরে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় কোনো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেনি। সর্বশেষসহ ২৪টি অগ্নিকান্ডের সবকটি ঘটেছে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায়। প্রথমে ২০০২ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের কটকা ও নাঙ্গলী এলাকায় আগুন লাগে। ২০০৫ সালে পচা কুরালিয়া ও গুটাবাড়িয়া সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমরবুনিয়া, খুরিয়াখালী, পচাকুড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকুড়ালিয়া, নাঙ্গলী ও ডুমুরিয়া এলাকায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে, ২০১১ সালে নাঙ্গলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে, ২০১৬ সালে পচাকুড়ালিয়া, নাঙ্গলী ও তুলা তলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসার সিলা এলাকায়, ২০২১ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি ধানসাগার, ৩ মে শরণখোলা দাসের ভাড়ানি ও ৪ মে একই এলাকায় আবারও আগুন লাগে। সর্বশেষ ৪ মে ২০২৪ চাঁদপাই রেঞ্জের আমারবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের সুবিধার্থে আসাধু জেলেরা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে বনের বিভিন্ন স্থান ফাঁকা করে ফেলে। পরবর্তী সময় তারা ওই স্থানে জাল পেতে মাছ ধরে। বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট হলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। শুধু আগুনে সুন্দরবনই পুড়ছে না। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে একশ্রেণির চক্র। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি। এর আগে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনায় কারণ হিসেবে বনে মধু সংগ্রহকারীদের ফেলে যাওয়া আগুনের কুন্ডলি, জেলেদের ফেলে দেওয়া বিড়ি-সিগারেট, বন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতিশোধমূলক আচরণ, অনাবৃষ্টির খরা দাবদাহ এবং দুষ্কৃতকারীদের ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরার বিষয় রয়েছে বলে বিগত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে জানা যায়। এ কারণে এ আগুন লাগার দায়ভার কোনোভাবেই বন বিভাগ এড়াতে পারে না। আগুন লাগার জন্য দায়ী অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তারা। অদক্ষ মধু সংগ্রহকারীদের কারণেও এ আগুন লাগতে পারে। এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও সরকারকে আরও উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এটি। জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অন্যতম এক আকর্ষণীয় স্থান। শৌর্যবীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রিয় আবাসভূমি এটি। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফনী ও বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন- যা দেশের অহংকার। দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম মানগ্রোভ বনভূমি আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস আর সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস বা হৃৎপিন্ড। কিন্তু সেই সুন্দরবন মনুষ্য সৃষ্ট অগ্নিকান্ডের ন্যায় নানা অবহেলায় আজ চরম হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার পাপাশাপাশি, সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতেও যেমন, ঠিক তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের মোট বনজসম্পদের একক বৃহত্তম উৎস সুন্দরবন। কাঠের ওপর নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের এক বিশাল অংশ জোগান দিয়ে আসছে সুন্দরবন। বহুমানুষ সুন্দরবন কেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় কখনো অগ্নিকান্ডে আবার কখনো নানা অজুহাতে নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বনটি। অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে, ঘূর্ণিঝড় 'আম্পান'-এর আক্রমণে মানুষের মতো সুন্দরবনও মরিয়া হয়ে বুক পেতে প্রমাণ করেছে, সেই আমাদের বিপদের সবচেয়ে বড় বিশ্বস্ত বন্ধু। সুন্দরবন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঢালস্বরূপ বর্মন হিসেবে কাজ করেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় 'আম্পান'-এর ক্ষেত্রেই ঘটেনি। এর আগে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বরে বুলবুল, ২০০৯ সালের ২৫ মের ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সিডর মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল; প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। গবেষকরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি সুন্দরবন। সিডর, আইলা ও বুলবুলের সময় সুন্দরবন মানব বর্মনের ন্যায় রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে অথচ মানব সৃষ্ট কিছু কারণে সুন্দরবন ও এরকম প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। আর সুন্দরবনের পাশে নির্মিতব্য রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্র 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দেখা দিয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া সুন্দরবন। এভাবে চলতে থাকলে একমাত্র প্রাকৃতিক বর্মন সুন্দরবন হারিয়ে যেতে বেশি দিন সময় লাগবে না। এজন্য সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষায় সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলা সাফল্য ধরে রাখতে হলে এসব বিষয়ে সক্ষমতা ধরে রাখার পাশাপাশি আমাদের আরও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। সুন্দরবনের মোট আয়তনের প্রায় ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বনসমুদ্র থেকে উঠে আসা দুর্যোগেগুলোকে প্রথম মোকাবিলা করে। বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন অক্সিজেনের এক বিশাল ফ্যাক্টরি হিসেবে কাজ করে। সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত বলে সুন্দর বন নামটি সর্বমহলে গৃহীত। হাজারো জীববৈচিত্র্যের মধ্যেও সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত। এর অর্থনীতিক গুরুত্বও অনেক। সুন্দরবন থাকার কারণে আমরা সৌভাগ্যবান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সুন্দরবনকে আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কখনো উন্নয়নের নামে, আবার কখনো ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় দলগত স্বার্থের কারণে। খবরে প্রকাশ, অগ্নিকান্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। এ তিনটি সুপারিশ হলো সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকান্ড প্রবণ এলাকার প্রতি দুই কিলোমিটার পর পর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং ভোলা নদীর পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলনের রশি দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তাছাড়া বাংলাদেশের ফুসফুস বা হৃৎপিন্ডখ্যাত সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য লোকালয় সংলগ্ন নদী খাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বশেষ সুন্দরবনে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে বন বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি তদন্ত করে তদন্ত রিপোর্ট দেবে, দায়ীদের চিহ্নিত করবে, কার অবহেলা কতটুকু তাও বের হবে, শাস্তির সুপারিশও করবে কিন্তু কে দায়ী তা হয়তো কেউ জানবে না। তবে যেই দায়ী থাকুক না কেন, বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস সুন্দরবনকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের এবং সুন্দরবনকে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই রক্ষা করতে হবে। অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক