বাঙালিয়ানাই রবীন্দ্রনাথের শক্তি
রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত উন্নত মননের মানুষ। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির রসেপুষ্ট একজন হৃদ্য পরিপূর্ণ বাঙালি। সব সৃষ্টিতে তার পরিচয় আমরা বারবার দেখতে পাই।
প্রকাশ | ০৮ মে ২০২৪, ০০:০০
অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুলস্নাহ সিকদার
'আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান
না জানি কেনরে এত দিন পরে জাগিয়ে উঠিল প্রাণ।'
যিনি কথা বলেছেন পাখির সঙ্গে, তিনি বাংলার পাখির কথা বুঝতেন। তাই হয়ত তিনি পাখির কথাকে গানের সুরে রূপ দিতে পেরেছিলেন। তিনি নীল আকাশে, শীতল বাতাসে উড়ে বেড়াতেন। কেননা, বাংলার আকাশ তার জন্য ছিল উন্মুক্ত, তাই বাতাসের তরঙ্গকে সুর তরঙ্গে রূপ দিতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলার মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বাংলার প্রকৃতিকে দেখেছেন, মিশেছেন মাটির সঙ্গে, সে মাটির উপরে পড়ে থাকা গাছের পাতার মর্মর শব্দকে সুরের মূর্ছনায় মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তিনি সাদা চাদরে ঢেকে রাখা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াতেন, সে মেঘের বৃষ্টির ফোটায় মিশে আবার ফিরে আসতেন বাংলার ভূমিতে, এই বৃষ্টি পড়ার তালকে শব্দের ঝঙ্কারে রূপান্তর করেছেন। তিনি বাংলার শ্যামল ফসলের ক্ষেতে চড়ে বেড়িয়েছেন, ফসলের মাঠের শন-শন আওয়াজকে ছন্দে ছন্দে গেঁথে ছন্দময় গানের সুরারূপ করেছিলেন। তিনি বাংলার নদীর সঙ্গে স্রুতের মাঝে ভেসে বেড়িয়েছেন অসংখ্য সকাল-দুপুর, চলার পথে নদীর কলধ্বনিকে তিনি বীণার সুরে সুরারোপিত করেছেন। বাংলার বর্ষণসিক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে তিনি নিজেকে মিশিয়েছেন অবলীলায়, বর্ষণসিক্ত প্রকৃতির মাঝে নগ্নদেহ কৃষকের ক্লান্তিকেও প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। কখনো কখনো বাংলার প্রকৃতির নির্মম নিষ্ঠুর চরিত্রকেও তিনি এমনভাবে অলংকৃত করেছিলেন- যেন প্রকৃতির নির্মমতাও শীতল হয়ে বাংলাকে তাদের ধ্বংসের তান্ডব থেকে মুক্ত করে যেতে রাজি হয়েছে। তিনি এ সবকিছু নিজে বাঙালি হিসেবে বাঙালিয়ানার শক্তি দিয়ে করেছিলেন। রবি ঠাকুর একজন মানুষ ছিলেন- যিনি বিশ্বসাহিত্য দরবারে শুধু বাংলা সাহিত্যকে উপস্থাপনই করেননি বরং বলতে হবে একেবারে আন্তর্জাতিক মানের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি-ই বিশ্ব কবি, সব কবির গুরু- কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যে তার অসাধারণ অবদান সাড়া বিশ্বকে বিস্মিত করেছে, সমীহ জাগানো এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে বাংলা সাহিত্যকে।
রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন তার সৃষ্টির গুণে। তার গান, কবিতা, ছোট গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, এমনকি চিঠিপত্র সবই বাঙালিয়ানাসমৃদ্ধ, অসাধারণ সৃষ্টি। বাংলা 'ব'-দ্বীপের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত কিন্তু এর যে শক্তি, সম্ভাবনা, এ মাটির যে শক্তি, এর সংস্কৃতির যে শক্তি, প্রকৃতির যে শক্তি, এ শক্তি অনেক বড়, অনেক হৃদয়বান। বাংলার এই বিশালত্বের জায়গাটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বাঙালি জীবনের প্রায় সব কর্মের, কৃষ্টির, সংস্কৃতির প্রাত্যহিক জীবনের সব কাজেই, সব শাখাতেই তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন এবং সেই সঞ্চিত শক্তিই তার এই বিশাল সৃষ্টি কর্মের মূল প্রেরণা ও মূল উপজীব্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের আগেও বাংলা সাহিত্যের অনেক গুণী মানুষ কাজ করেছেন, অবদান রেখেছেন, রবি ঠাকুর সেখান থেকেও নিশ্চয়ই অনেক রস আস্বাদন করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির যে শক্তিমত্তা, বিশালতা, গভীরতা এবং যে আকর্ষণ সেটি একেবারেই ব্যতিক্রমী ও অতুলনীয়। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে অন্য যারা কাজ করেছেন তাদের সঙ্গে তুলনা করলে তা বলতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা সাহিত্যে জগতে তখন বিশ্বসাহিত্যে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, ল্যাটিন বা ফার্সি ভাষা সাহিত্য কর্ম অনেক অগ্রসর এবং প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং, ওই সাহিত্যাঙ্গনও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণার জায়গা, শেখার জায়গা হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্বসাহিত্যের অপরাপর ভাষা বা সাহিত্য কর্ম তাকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করবে সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্যের যে মূল শক্তি এবং তার যে সম্ভাবনা সেটি মূলত আমরা দেখতে পাই তার একেবারে ব্যতিক্রমভাবে। তিনি নিজস্ব ধারায় নিজস্ব লেখনীতে বাঙালির সংস্কৃতিকে, মাটিকে, প্রকৃতিকে, এখানকার নদীকে, এখানকার বাউলকে, এখানকার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে তিনি কাছ থেকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে, উৎসাহিত হয়ে তিনি তা উপস্থাপন করেছেন। যে উপস্থাপনা হৃদয়গ্রাহী, হৃদয়ঘনিষ্ঠ এবং বলতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত। কাজেই রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই যে কোনোভাবেই বলা যায়, তার সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের যে আবহ সেই আবহে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয়েছেন, হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকেই বিশ্বসাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় কিন্তু তার গানে, তার কবিতা ও অন্যান্য সৃষ্টিতে দেখতে পাই সম্পূর্ণ নিজস্বতা। তার সব সৃষ্টি, সব কর্মে ঘুরে ফিরে বাঙালিকে এবং বাঙালিয়ানাকেই বড় করে দেখার চেষ্টা করেছেন। বাঙালির দুঃখ-সুখ, ভালোলাগা, না লাগা, বাঙালির সম্ভাবনা, হাসি-কান্নাকে তিনি তার সাহিত্যে সচেতনভাবে স্থান করে দিয়েছেন। তিনি কৃষকের কথা বলেছেন, তিনি শ্রমিকের কথা বলেছেন, নিঃস্ব ও ভূমিহীনের কথা বলেছেন, ছাত্র-শিক্ষকের কথা বলেছেন, তিনি অবলা নারীর কথা বলেছেন, তিনি রাজনীতির সম্ভবনাকে চিহ্নিত করেছেন, তিনি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা চিক্তা করেছেন, বাঙালির চিকিৎসা সংকট, শিক্ষা এবং তার সম্ভাবনার কথা তার সাহিত্য কর্মে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তার গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস সব পাঠকের মনে এক অসাধারণ অনুভূতির সৃষ্টি করে। যে অনুভূতির প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন পাঠক মহলে ভিন্ন ভিন্ন আবেশের সৃষ্টি করে। তার একই গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের মনে ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রকাশে সমর্থ; কিন্তু কোনোটিই অকল্যাণকর নয় বরং তাতে কল্যাণকর শক্তির জোগানদার। তার একই গানে সব প্রেমিক হৃদয়ে প্রেমের ভাব জাগে আবার একই গানে সাধক আধ্যাতিক জগতে নিজেকে সপে দিতে পারেন। এমন বৈচিত্র্য অন্য কোনো সাহিত্যিকের লেখনীতে পাওয়া দুঃসাধ্য।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত উন্নত মননের মানুষ। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির রসেপুষ্ট একজন হৃদ্য পরিপূর্ণ বাঙালি। সব সৃষ্টিতে তার পরিচয় আমরা বারবার দেখতে পাই।
বিশেষ করে তার গান, গানের যে বাউওলিয়ানা, বাঙালির মাঠের পথের জীর্ণ কুটিরের বাসিন্দার যে আকাঙ্ক্ষা, প্রাণের যে বাণী সেই বাণী তিনি তার গানে ফুটিয়ে তুলেছেন, কবিতাতেও বাঙালির প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়
বিজাতীয়দের দ্বারা বাঙালির শাসিত হওয়ার যে রাজনৈতিক সংকট সেটি রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছে। আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তাকে নাইট উপাধি বর্জন করতে দেখেছি। আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের গান্ধীজীর সঙ্গে এবং অন্যান্য দেশ প্রেমিক রাজনৈতিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। তিনি সাধারণ শ্রমিক কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের বেদনায় বিভিন্ন সময় অনেক গান রচনা করেছেন।
আজকে সেই মানুষটির প্রতি আমাদের এই শ্রদ্ধা আসলে রবীন্দ্রনাথের বাঙালিয়ানায় শক্তিতে গড়ে ওঠা তার কাজের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। রবীন্দ্রনাথ এই যে পরিপূর্ণ বাঙালি ছিলেন, ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিধর বাঙালি সংস্কৃতির ধারক এবং রূপকার। সংস্কৃতির যে সার্বজনীন রস সৃষ্টির শক্তি নির্মাণের মাঝে আমরা রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই। কাজেই আজকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধা, শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও রূপকারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের চর্চা আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবং বাঙালিয়ানার কল্যাণকর প্রাত্যহিক জীবনবোধের চর্চা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে কবির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুলস্নাহ সিকদার : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়