বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অজুহাত তুলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। আজকাল হামেশাই খবর বেরোয় বিএনপি নেতারা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। বৈঠক শেষে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি নেতাদের ছবি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। এ সবকিছু কোনোভাবেই রাজনীতির আদর্শিক শিষ্টাচার নয়। এ বিষয়ে সব আচরণ বিধিসম্মত, ন্যায়নীতিভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনের মূল্যবোধ অনুসরণ করে চলা উচিত।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
  ০৭ মে ২০২৪, ০০:০০
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি বাংলাদেশের অবস্থান

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত মানবাধিকার বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। বিশ্বের কোন দেশে মানবাধিকারের ধরন কেমন, কোন দেশের পয়েন্ট কত- তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য সংগঠনের প্রতিবেদন লক্ষ্য করে থাকি। গত কয়েকদিনেই গণমাধ্যম সূত্রে প্রায় ৩ থেকে ৪টি প্রতিবেদন আমাদের চোখে পড়ল। তাদের প্রতিবেদন দেখে মনে হয়, তারা বিশ্বেও সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার রক্ষা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে তারা মানবাধিকার বিষয়ক বিশ্বমোড়ল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেন ২০২৩ সালের স্টেট ডিপার্টমন্টের দেশভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বলেন, 'স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোই হলো সঠিক কাজ।' তিনি প্রতিবেদনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, এই প্রতিবেদনগুলো প্রায় ২০০টি দেশ এবং অঞ্চলজুড়ে মানবাধিকারের রেকর্ডগুলোর একটি বাস্তবসম্মত, পদ্ধতিগত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। কিন্তু তাদের এই মানবাধিকার প্রতিবেদনের মূল দর্শন তারা নিজেরাই কি অনুসরণ করে কিনা তা নিয়ে সবার মনেই প্রশ্ন রয়েছে। অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র করে যাচ্ছে। অথচ প্রতিনিয়ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছেন।

গত ৩০ এপ্রলি যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকার রিপোর্ট লেখে, কিন্তু আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ হত্যার ঘটনার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং নিন্দা জানান। একজন সাহসী বিশ্বনেতার ভূমিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে মূল্যায়ন করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ নজিদের মাথা নত না করে বরং তাদের কর্মকান্ডের এই সমালোচনাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। আমেরিকায় ইসরাইলবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের হামলার কথা উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন।

অন্য রাষ্ট্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই খবরদারির বিষয়টি কোনোভাবেই বাংলাদেশ সমর্থন করে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাহসী প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের দাঁতভাঙা জবাব। উলেস্নখ্য, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। গাজায় ইসরাইলের অভিযান ও তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ করছেন ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ দমনে ধরপাকড় হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য নাগরিক তাদের এই দমননীতির বিরোধিতা করেছেন। একজন মহিলা প্রফেসর, যিনি তার নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। অসংখ্য নির্মম নির্যাতনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের পেটে জোরপূর্বক ইউরোপ থেকে নিয়ে আসা ধর্মান্ধ জায়নবাদী ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল নামক একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর সেই অঞ্চলে বিরামহীনভাবে গণহত্যা আর তার আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ চলছে। সেই গণহত্যাকেও মদত দেওয়ার জন্য মার্কিন কংগ্রেস সম্প্রতি ইসরাইলের জন্য ২৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশসহ অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে খুব সোচ্চার।

তাদের আচরণে সব সময়ই স্ববিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তারা যে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রায়ই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা প্রকাশ করে- তা কি বিশ্ববাসীর জন্য সর্বজনীন? যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি দ্বিমুখিতা এবং আত্মপ্রতারণা নয়? গাজায় গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এমনকি অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। যুক্তরাষ্ট্র যে এই গণহত্যা স্পষ্টভাবে মদত দিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট। মানবিধাকারের এবং গণতন্ত্রের যে বুলি যুক্তরাষ্ট্র দিনের পর দিন দিয়ে চলেছে- তা কি নির্লজ্জতার শামিল নয়?

বছরদেড়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল চীন। চীনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ওই প্রতিবেদনে চীন বলে, যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধারকর্তা হিসেবে নিজেকে দাবি করে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতাসহ সম্পদ কুক্ষিগত করার ঘটনা অতি সাধারণ বিষয়। সেখানে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বাড়ছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা সেখানে ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার। চীনের দেওয়া প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদকের অপব্যবহারে আমেরিকানদের মৃতু্যর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এ কারণে প্রতি বছর আমেরিকাতে ১,০০,০০০-এরও বেশি মানুষের মৃতু্য হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আমেরিকান রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। এর ফলে, তারা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়া এবং সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার ইচ্ছা এবং বস্তুনিষ্ঠ ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং মানবাধিকারের নিজস্ব কাঠামোগত নানা সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মার্কিন প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় আড়াইশ' সাংবাদিককে গ্রেপ্তার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর বাইরে শত শত সাংবাদিক বৈষম্য, শারীরিক নির্যাতন, আক্রমণ ও হুমকি ধমকির শিকার হয়েছেন। মানবাধিকারের মূলনীতি সাম্য ও বৈষম্যহীনতা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা এখনো অনেক দূরে। এই তো কয়েক দশক আগেও ইউরোপের অনেক দেশে আফ্রিকার কালো মানুষকে খাঁচাবন্দি করে আনন্দ উপভোগ করা হতো। বর্ণবাদ সমাজ ও রাজনীতির গভীরে প্রোথিত রয়েছে এসব দেশে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অজুহাত তুলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। আজকাল হামেশাই খবর বেরোয় বিএনপি নেতারা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। বৈঠক শেষে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি নেতাদের ছবি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। এ সবকিছু কোনোভাবেই রাজনীতির আদর্শিক শিষ্টাচার নয়। এ বিষয়ে সব আচরণ বিধিসম্মত, ন্যায়নীতিভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনের মূল্যবোধ অনুসরণ করে চলা উচিত।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে