সড়কে মৃতু্যর মিছিল বন্ধ হবে কবে?

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটে নির্মাণ ত্রম্নটি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

প্রকাশ | ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০

সাগর জামান
সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে মৃতু্যর মিছিল। গণমাধ্যমে চোখ রাখলে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। মহাসড়কে মৃতু্যর মিছিল কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিনই অবেলায় হারিয়ে যাচ্ছে কত না তাজা প্রাণ। প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর পাশাপাশি পঙ্গুত্ববরণ করছে অসংখ্য মানুষ। এ বাস্তবতা শঙ্কিত করে দিচ্ছে আমাদের সবাইকে। সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে যে প্রতিদিন এ দেশে গড়ে ৬৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন। যা রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে গত বছরের প্রথম তিন মাসের চেয়ে এ বছর দুর্ঘটনা ৪৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এমন তথ্য ভাবিয়ে তুলছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। সজন হারানো মানুষের হাহাকার শোনা যাচ্ছে রোজই। সড়ক দুর্ঘটনায় হতভাগ্য মানুষের মৃতু্য শোকে আত্মহারা পরিবার সজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকা। বিষণ্নতা আর শোকে ডুবিয়ে দেয় এলাকার পরিচিত চেনাজানা মানুষকে। বাড়ি থেকে বের হচ্ছে সুস্থ-সবল মানুষ, ঘাতক যান কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। অথবা পঙ্গু করে দিচ্ছে চিরতরে। সড়কে রয়েছে মৃতু্য ফাঁদ। জীবনে সঙ্গী হয়ে মৃতু্য আমাদের সাথে থাকে। হাতছানি দেয় মৃতু্য। মানুষ পথে নামে। মানুষের পথযাত্রা শেষযাত্রায় পরিণত হচ্ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না, বরং দিনে দিনে বাড়ছে কেবল। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের পরিবার সজনরা বিলাপ করা ছাড়া কিছুই করতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনায় একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃতু্য হলে বা পঙ্গু হয়ে গেলে পরিবারের জন্য এই দুর্ঘটনা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। শুধু পরিবারের জন্য গভীর শোক নয় পুরো পরিবারকে অচল করে তোলে। বিশাল অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। উপার্জনের চাকা থেমে যায়। পথে বসে যায় গোটা পরিবার। ভায়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চালকের বিরুদ্ধে মামলা করে বিচার পাওয়া কঠিন কাজ। ক্ষতিপূরণ মামলা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়া সহজ কথা নয়। বরং মামলা চালাতে খরচ হয়ে যায় অনেক অর্থ। এতে আরো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর জন্য যারা দায়ী তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া জরুরি। দায়ীদের শনাক্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ ও তৎপরতার অভাব রয়েছে বলে মনে হয়। তথ্য বলছে বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের। দুর্ঘটনাজনিত কারণে মামলা হয়েছে প্রায় এক লাখের মতো। বছরে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ক্ষতি হয় শতকরা দেড় ভাগ মানে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। অথচ একটু সচেতন হলেই অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া জরুরি। সচেতনতা দিয়ে সড়কের মৃতু্যর বিভীষিকা অনেকাংশে ঠেকানো সম্ভব। চালকেরা যদি বেপরোয়াভাবে গাড়ি না চালায় পথচারী যদি সতর্কতার সাথে রাস্তা পারাপার করে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। সড়ক নিরাপদ করার জন্য উদ্যোগ যে কম নেয়া হয়েছে তা নয়। অনেক উদ্যোগ নেয়া হলেও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু বাস-ট্রাকের বেপরোয়া চলাচল সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নয়। সড়কে বেড়েছে মোটর সাইকেলের সংখ্যা সে কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও বেশি হচ্ছে। কিশোর যুবকরা বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ। কেউ বা মোটর সাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ হারাচ্ছে। কেউ বা নিয়ত্রণ হারিয়ে মৃতু্যবরণ করছে। বাস-ট্রাক মোটর সাইকেল যারা চালাচ্ছেন তাদের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করতে গেলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির উদাসীনতা অস্বীকার করা যায় না। দ্রম্নতগতির যানবাহন যেমন বাস-ট্রাক মাইক্রবাস প্রাইভেট কার পিকআপ ইত্যাদি যান চালকদের অদক্ষতা ও অসতর্কতার কারণেই ঘটছে দুর্ঘটনা। সন্তানদের প্রতি পিতামাতার অন্ধ ভালোবাসা, শাসনের অভাব আর বেপরোয়া আচরণ প্রশ্রয় দেয়ার কারণে কিশোর ও যুবকদের হাতে খুব সহজেই চলে আসছে মোটর সাইকেল। অন্য দিকে কলুষিত রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের পৃষ্ঠপোষকতাকেও দায়ী করা যায়। অল্প বয়সি ছেলেরা যাতে মোটর সাইকেলের প্রতি আকৃষ্ট না হয় বাবা মাকে সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অনেক সময় মদমত্ত হয়ে অনেক বেসামাল চালক গাড়ি চালায় এতে দুর্ঘটনা ঘটে। চালকের অদক্ষতার কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। সেটা স্বল্পগতির যানবাহন উচ্চগতির যানবাহন উভয় ক্ষেত্রেই ঘটে। সড়কে অদক্ষ চালকেরা চালাচ্ছে ইজিবাইক, সিএনজি, নসিমন, ভটভটি ইত্যাদি স্বল্পগতির যানবাহন। সড়ক-মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকার কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও দ্রম্নতগতিতে গাড়ি চালানো তো আছেই। প্রতিযোগিতা, অন্য গাড়িকে অতিক্রম করার প্রবণতা এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করার জন্য দুর্ঘটনা হচ্ছে। এ ছাড়া চালকের সহযোগী যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই চালক হয়ে যাচ্ছে। অনেক চালকরা বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। এ দেশে চালকেরা বিশ্রাম না নিয়ে দীর্ঘ সময় বিরতিহীন গাড়ি চালায়। এটাও দুর্ঘটনার একটি কারণ। বিভিন্ন সংবাদপত্রে গত এক বছরের সড়ক দুর্ঘটনার যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনের যে তথ্য উঠে এসেছে সে প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালে ঢাকা বিভাগে এক হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৭১২ জন নিহত এবং দুই হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে এক হাজার ২৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ২০৫ জন নিহত, দুই হাজার ২৯৪ জন আহত হয়েছে। খুলনা বিভাগে ৭৬৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬৪ জন নিহত, এক হাজার ৭৮ জন আহত হয়েছেন। বরিশাল বিভাগে ৩৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত, ৯৯২ জন আহত হয়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন নিহত, ৬৬৫ জন আহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৩ জন নিহত, ৯২৬ জন আহত হয়েছেন। রংপুর বিভাগে ৫৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬ জন নিহত, ৮৬৮ জন আহত হয়েছেন ও রাজশাহী বিভাগে ৭৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৯৩ জন নিহত এবং এক হাজার ১৬৮ জন আহত হয়েছে। সড়কে দুর্ঘটনার শিকার এক হাজার ৯৫০ জন চালক, ৯৬৮ জন পথচারী, ৪৮৫ জন পরিবহণ শ্রমিক, ৬৯৭ জন শিক্ষার্থী, ৯৭ জন শিক্ষক, ১৫৪ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৯৮৫ জন নারী, ৬১২ জন শিশু, ৩০ জন সাংবাদিক, ৩২ জন চিকিৎসক, ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আটজন আইনজীবী, ১০ জন প্রকৌশলী ও ১১১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৭৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন- যাদের মধ্যে ১৬ জন সেনা সদস্য, ৪০ জন পুলিশ সদস্য, ১ র?্যাব-সদস্য, সাতজন বিজিবি সদস্য, তিনজন নৌবাহিনীর সদস্য, তিনজন আনসার সদস্য, দুইজন ফায়ার সার্ভিস সদস্য, একজন এনএসআই সদস্য। এ ছাড়া রয়েছেন ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৫ জন সাংবাদিক, ৬৪৭ জন নারী, ৪৬৬ জন শিশু, ৪১৬ জন শিক্ষার্থী, ৮১ জন শিক্ষক, এক হাজার ৫২৬ জন চালক, ২৬০ জন পরিবহণ শ্রমিক, আটজন প্রকৌশলী, সাতজন আইনজীবী, ৭৭ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ২২ জন চিকিৎসক। সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট দুর্ঘটনার ৫২.৮৩ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা, ২০.৫ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪.২৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ১১.৪ শতাংশ বিবিধ কারণে, ০.২৭ শতাংশ যানবাহনের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং ০.৬৮ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটে নির্মাণ ত্রম্নটি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে। সাগর জামান : কবি ও প্রাবন্ধিক