জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ

প্রকাশ | ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০

তৌহিদ-উল বারী, ঢাকা
অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধ-বিগ্রহের বাইরে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বেশ মারাত্মক রকমের আতঙ্কের নাম জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন এই প্রজন্ম ও সম্ভবত ইতিহাসের যেকোনো প্রজন্মকে মোকাবিলা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। কেননা আমাদের পৃথিবী আজ ডুবে আছে এক ভয়াবহ বায়ুসমুদ্রে। আমরা জানি, বায়ুমন্ডলের গড় অবস্থাই জলবায়ু। কিন্তু জলবায়ুর প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তাপ। পৃথিবীতে এ তাপশক্তির মূল উৎসই হলো সূর্য। কিন্তু বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুর নজিরবিহীন পরিবর্তন ঘটে। এটা আমাদের নিঃসন্দেহে মানতে হবে। কেনই আতঙ্কের নাম বলছি জলবায়ু পরিবর্তন? তা বুঝতে হলে বেশি কিছু নয়, সবশেষ ভুক্তভোগী সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের দিকে তাকালে কিছুটা স্পষ্টতা খুঁজে পাওয়া যাবে। ভারী বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় টালমাটাল আরবের এই শহর। আবহাওয়াবিদদের সিংহভাগের মত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই দুবাই এবং সংলগ্ন এলাকায় খানিক অস্বাভাবিকভাবেই এই ভারী বৃষ্টিপাত। বায়ুমন্ডল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি উত্তপ্ত থাকলে, তা শুধু স্থলভাগ থেকে নয়, জলভাগ থেকেও বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে। যার ফলাফল, দুবাইয়ে ভারি বর্ষণ আর পরে বন্যার মতো মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় দুবাইয়ের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু বাংলাদেশ! বাংলাদেশের আবহাওয়ার চিত্রের দিকে তাকালে তার চেয়ে মারাত্মক চিত্র চোখে ভাসবে। এখানে জলবায়ুর পরিবর্তন কতটা যে প্রভাব ফেলেছে তা কেবল রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার দিকে তাকালেই বুঝতে পারব। যেথানে চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এত তাপমাত্রা বৃদ্ধি কেন? কেন এই তাপমাত্রার পরিবর্তন? এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের কি হবে? আসলেই কি কোনো বিপদ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে? দেখি কি বলছে সমীকরণ:-এসব নিয়ে বলার শুরুতেই উঠে আসবে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা। এই বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে একদিকে যেমন শীতের সময়কাল কমে আসছে অন্যদিকে দীর্ঘ হচ্ছে গ্রীষ্ম ও তীব্র হচ্ছে গরম। আর এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ গ্রিন হাউস গ্যাসের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশ্বের উন্নত ও অগ্রসরমান উন্নয়নশীল দেশগুলো এই গ্যাস উৎপাদনে দায়ী হলেও ক্ষতিকর ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। গ্যাসগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড অন্যতম। আমরা দেখেছি, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র, যা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। এভাবে রাশিয়া, ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল ও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ। জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে অস্ট্রেলিয়া। সে তুলনায় বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনের হার অত্যন্ত কম, শতকরা প্রায় শূন্য দশমিক ২ ভাগ মাত্র। এতে বোঝা যায়, উন্নত ও দ্রম্নত উন্নয়নশীল দেশগুলো পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে দায়ী। অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনে গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণকেই দায়ী মনে করলেও মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণের কারণে সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে আমি মনে করি। গ্রিনহাউস ইফেক্ট মূলত সূর্যের তাপস্থল ও জলভাগস্থ সবকিছু ও বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে। এই তপ্ত স্থান বা বস্তুগুলো যখন ঠান্ডা হতে থাকে, তাদের শোষিত তাপ বিকিরিত হয়ে প্রধানত অবলোহিত বা ইনফ্রারেড রশ্মি হিসেবে বায়ুমন্ডলে ফিরে যায়। পৃথিবীর বায়ুস্তরে কিছু গ্যাসীয় উপাদান ও কণা পদার্থ (পার্টিকুলেট ম্যাটার) আছে, যেগুলো এই বিকিরিত তাপ শুষে নিয়ে ও ধারণ করে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বায়ুস্তর অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারকে উষ্ণ করে তোলে। আসলে এ প্রক্রিয়াটি পৃথিবীকে বসবাসের যোগ্য উষ্ণ রাখে এবং জীবজগতকে সুরক্ষিত রাখে। তাপ শোষণ ও ধারণের ক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা পালন করে। ২০১৯ সালের যুগান্তরের একটি রিপোর্ট মতে, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গ্রিনহাউস ইফেক্ট যদি না থাকত, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হতো হিমাঙ্কের ১৮ ডিগ্রি নিচে। হিমশীতল পৃথিবীর বুকে তরল আকারে কোনো পানির অস্তিত্ব থাকত না। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের গঠন ও গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণেই পৃথিবীর বুকে আজও লাখ লাখ জীববৈচিত্র্যের উদ্ভব ঘটে চলেছে। সুতরাং গ্রিনহাউস ইফেক্টকে ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রক্রিয়া ভাবার অবকাশ নেই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমন্ডলে তাপশোষী কিছু গ্রিনহাউজ গ্যাস ও কার্বন কণার নির্গমন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কারণ বিদু্যৎ উৎপাদন, যানবাহন চলাচল ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের জন্য যথেচ্ছভাবে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানি। এতে উপজাত হিসেবে বাতাসে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও বস্ন্যাক কার্বন। এদিকে কৃষিকাজ, পশুচারণ, নগরায়নসহ নানা উদ্দেশ্যে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার মতো বনাঞ্চলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। আর এভাবেই বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। যাকে আমরা বলছি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা গেস্নাবাল ওয়ার্মিং। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনে দিন দিন মারাত্মক প্রভাবের সম্মুখীন হতে চলেছে এশিয়ার বাংলাদেশ। দেশটিতে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি। আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০-এ প্রকাশিত গেস্নাবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের ওপর। উলেস্নখ্য, ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। আমাদের একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, জলবায়ুর এই পরিবর্তন দুই-একদিন বা দুই-এক বছরে হয়নি। দীর্ঘ বছরের পর বছর মানুষ পরিবেশকে তার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে গিয়েই বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে। নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজাড় করেছে। করেছে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি। আর এইভাবে চলতে থাকলে আগামীর বাংলাদেশ তথা পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। জলবায়ু পরিবর্তনে মনুষ্যসৃষ্ট কারণসমূহ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। হতে হবে সচেতন। যেমন: পরিবেশ বিজ্ঞানের জ্ঞান রাখা, বায়ুদূষণ রোধ (কার্বন ডাই-অক্সাইড এর কম ব্যবহার), পানিদূষণ প্রতিরোধ, মাটিকে দূষণমুক্ত রাখা ইত্যাদি। আজকের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমরা পরিবেশ এবং প্রকৃতির যে ভয়াবহ রূপ ও পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছি, যার প্রেক্ষিতে দিন দিন অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, আকস্মিক বন্যা- তাতে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এতে উদ্বিগ্ন না হয়ে, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। বাঁচাতে হবে বিপন্ন এ পৃথিবীকে। আসুন, আমরা সবাই মিলে পৃথিবীটাকে রক্ষা করি, সুন্দর করি এখানের পরিবেশ। বাসযোগ্য হোক এ পৃথিবী।