সড়কে মৃতু্যর মিছিল বন্ধ করুন

প্রকাশ | ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০

মাহমুদুল হক আনসারী, ঢাকা
লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ। কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না। কে কার কথা শোনে। কিন্তু তা যেন কোনো কাজেই আসছে না। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। ২১ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা হয়, ১৫ দিনে ঝরল ৩৬৭ প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনা ৩৩৮টি। এতে বলা হয়েছে, প্রিয় সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদে আবার ফিরবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। রাস্তায় বেরুতেই যেন মৃতু্যর হাতছানি। নিহতদের স্বজনরা দাবি করছেন, দিনে দিনে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে অসময়ে অনেক স্বপ্নের অপমৃতু্য ঘটছে, থেমে যাচ্ছে অনেক পরিবারের গল্প। এ দুঃসংবাদ এখন যেন আমাদের নিত্যদিনের অঘটনে পরিণত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃতু্যর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় শোকাতুর পরিবারের বিলাপ আর আহাজারিতে ভারী হচ্ছে বাতাস। ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৪ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ নিহত এবং ১৩৯৮ আহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জানা যায়। বিগত ঈদের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১.২৫ শতাংশ, নিহত ২৪.০৮ শতাংশ, আহত ১৪৭.৪৩ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ সময় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ২৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬০ জন। আহত হয়েছেন ১২৬ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর ঈদকেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানির বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে আসছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এবারের ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ মানুষের বেশি যাতায়াত হয়েছে। সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ৪০.৫০ শতাংশ মোটর সাইকেল, ১৪.২৮ শতাংশ ট্রাকু পিকআপ কাভার্ডভ্যান লরি, ৬.৫০ শতাংশ কার মাইক্রো জিপ, ৫.৯৬ শতাংশ নছিমনুকরিম ট্রাক্টার লেগুনা মাহিন্দ্রা, ৬.১৪ শতাংশ অটোরিকশা, ১২.১১ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা, ইজিবাইক, ভ্যান, সাইকেল ও ১৪.৪৬ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। সড়কে এভাবে মর্মান্তিক মৃতু্যই যেন নিয়তি এখন। ফলে সড়কপথে ভ্রমণ করা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য হলো চালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, গাড়ির বেপরোয়া গতি এবং গাড়ির ফিটনেস না থাকা। সাধারণের মনে এখন একটাই প্রশ্ন মহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে? গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সড়ক দুর্ঘটনা তদারকির দায়িত্বে বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ ও জেলা প্রশাসন থাকলেও কোনো দপ্তরেরই এ সমস্যা রোধে তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলা পুলিশকে প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হয় এবং তা পাঠাতে হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ পেশ করেছিল। সংগঠনটি বলেছে, দক্ষ চালক তৈরি উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ'র সক্ষমতা বৃদ্ধি, যানবাহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পথচারীদের মধ্যে ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে সেগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি, সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, গণপরিবহণের চাঁদাবাজি বন্ধ, রেল ও নৌপথ সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই গণপরিবহণ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৯ বাস্তবায়ন করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। তবে ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন ও মোটর সাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা পালস্না দিয়ে বাড়ছে। পরিবহণ সেক্টরকে কিছু বললে হিতে বিপরীত। ধর্মঘটে চলে যায়। কাল ২৯ এপ্রিল চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হলেন বাঁশখালীর চক্ষু রোগী ৬ জন লোক। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, শ্যামলী পরিবহণ আর রোগীর মাইক্রো মোকো মোকি স্পর্ট সংঘর্ষে দুর্ঘটনা। তাহলে কি বুঝতে পারি, সম্পূর্ণভাবে এসব দুর্ঘটনা অসর্কতা থেকেই হচ্ছে। অদক্ষ ড্রাইভার, হেলপার, লাইসেন্স ছাড়া টোকেন নিয়ে ড্রাইভিং করা। রাস্তায় অতিরিক্ত গণপরিবহণ, নানা সমস্যায় জর্জরিত পরিবহণ খাত। প্রতিদিন অসংখ্য প্রতিবেদন হলেও বাস্তবে সড়কের শৃঙ্খলা মিলছে না। প্রিয় জীবন ও মানুষ হারানোর বেদনা সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। মূল্যবান জীবন বাঁচাতে আরও সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। দীর্ঘসময় থেকে পাওয়া তথ্যসমূহ কাজে এনে সড়ক নিরাপদে কাজ করতে হবে। মৃতু্যর মিছিল থামান। আমার সন্তান শিক্ষার্থীর নিরাপদ যাতায়াত রক্ষা করতে হবে। শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে খেলা খেলতে দেওয়া যাবে না। মূল্যবান প্রতিটি নাগরিক জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বুয়েট শিক্ষার্থী হত্যার বিচার প্রকাশ্য করতে হবে। তার মৃতু্যর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সড়কপথে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। অবৈধ যানবাহন রাস্তায় চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুর্নীতিবাজ বিআরটিএ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনুন। দুর্নীতির মাধ্যমে গাড়ির ডকুমেন্টস প্রদানকারী কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনুন। বিআরটিকে দালাল চক্রের চেইন থেকে দূরে রাখুন। অনভিজ্ঞ অপ্রাপ্ত বয়সের চালকের হাত থেকে পরিবহণ সেক্টরকে দূরে রাখুন। কঠোর হস্তে তা দমন করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে বলব অসাধু দুর্নীতিবাজ বিআরটিএর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন। আসুন মূল্যবান জীবন বাঁচাতে সড়কের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করি।