গাছ লাগান, ফিরবে পরিবেশের ভারসাম্য
প্রকাশ | ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০
আলকামা সিকদার, ঢাকা
বাংলাদেশ একমাত্র পৃথিবীর বুকে ষঢ়ঋতুর দেশ হলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না। নানা কারণে দেশে এখন ঋতুর বদল ঘটেছে। দিন যত যাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য তত হ্রাস পাচ্ছে। দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে কর্মজীবী মানুষের। পরিবেশের এমন বৈরিতার জন্য একমাত্র দায়ী হচ্ছি আমরা জনগণ। আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত নানা পণ্য ব্যবহার করি যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
এমন নানা প্রকার জিনিস রয়েছে আমাদের মধ্যে যেগুলো শত শত বছর পরিবেশের মধ্যে পড়ে থাকে যার কোনো ক্ষয় হয় না বরং পরিবেশকেই ক্ষতি করে চলে বছরের পর বছর ধরে। যেমন রয়েছে পলিথিন, পস্নাস্টিক, নানা ধাতব পদার্থ এবং কি নির্বিচারে গাছ কর্তন করা ও প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা। বিশেষ করে পরিবেশের মধ্যে আগ্রাসী প্রভাব ফেলেছে পলিথিন ও পস্নাস্টিক নামক মারণাস্ত্র ও পরিবেশ বিধ্বংসী বিদেশি জাতের নানা গাছ। যার প্রভাবে প্রাকৃতিক খাল-বিল নদীনালায় পতিত হয়ে ভরে যাচ্ছে। পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না সুবিধাজনকভাবে। পরিবেশ ধ্বংসকারী গাছের অধিক হারে পানি সেশনের কারণে মাটিতে পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে দেশীয় গাছ নির্বিচারে কর্তন ও প্রাকৃতিক বন অবাধে ধ্বংসের ফলে দিন দিন পরিবেশে তাপমাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
এ ছাড়া সর্বনাশা পস্নাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে দেশের নদনদী, খাল-বিল। অপচনশীল এ বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী, খাল, বিলের তলদেশ। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খালের পানি প্রবাহ, সু্যয়ারেজ লাইন। নদী ও খালের পাড় দখলেও ভূমিকা রাখছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও পস্নাস্টিক বর্জ্য। নদীর পাড়ের মাটি খুঁড়লে মিলছে ২০-২৫ বছরের পুরনো পলিথিন ও পস্নাস্টিক। পস্নাস্টিক ও পলিথিনের এমন আগ্রাসনের কারণে এই পদার্থগুলো গুঁড়ো এবং গলে মাটির বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে মিশে মানুষের খাদ্যচক্রে চলে যাচ্ছে এবং তা পরবর্তী সময়ে মানুষের শরীরের বিভিন্ন ক্ষতির কারণসহ ক্যানসার হয়ে যাচ্ছে।
আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও কোনো অজানা কারণে আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলেছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার। আর পস্নাস্টিক তো কোনো কথাই নেই। এজন্য নিসিদ্ধের কোনো আইন আছে বলে আমার জানা নেই। আর সে কারণেই হয়তো পস্নাস্টিক উৎপাদন ব্যবহার ও বাজারজাতকরণে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে উৎপন্ন হচ্ছে ৮ লাখ ২১ হাজার টনের বেশি পস্নাস্টিক বর্জ্য। এর ৪০ ভাগ পুনর্ব্যবহার হলেও ৬০ ভাগই ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশের বিভিন্ন স্তরে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানবদেহসহ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানে। পস্নাস্টিক পণ্য হালকা-পাতলা, সহজে বহনযোগ্য, টেকসই ও সস্তা। তাই পস্নাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। গত ফেব্রম্নয়ারিতে প্রকাশিত স্টকহোম রেসিলিয়েন্স সেন্টারের রিপোর্ট মতে, বর্তমানে বিশ্বে পস্নাস্টিক পণ্য পুনর্ব্যবহৃত হচ্ছে ১০ শতাংশেরও কম। অথচ, পস্নাস্টিকের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬.৭০ কোটি টন, যা বর্তমানে সব জীবের ওজনের তুলনায় চারগুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ২০০২ সালে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে একবার ব্যবহার্য পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়নি। আইনের এই ফাঁকের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ও পস্নাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। এই পলিথিন ও পস্নাস্টিক পরিবেশ বিপর্যয়ে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। যার প্রভাবের ফলে বাসযোগ্য পৃথিবী হয়ে উঠছে মরুভূমির পর্যায়ে। দিন দিন দেশেরসহ সারা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে অকল্পনীয় হারে। পলিথিন যেমন অপচনশীল তেমনি পস্নাস্টিকও অপচনশীল।
পস্নাস্টিকের জীবনচক্রের প্রথম ধাপ শুরু হয়ে জীবাশ্ম জালানি, অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশনের মধ্য দিয়ে। এই অনবায়নযোগ্য শক্তি উৎসগুলোকে পস্নাস্টিক উৎপাদনের কাঁচামাল, যেমন, ইথিলিন ও প্রোপিলিন পেতে ব্যবহার করা হয়। এই নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার ফলে বায়ু ও পানি দূষণ হয় এবং এর ফলে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড়সড় ঘটনা ঘটে। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রেনমেন্টাল ল বা আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৯৯ শতাংশ পস্নাস্টিকই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।
পলিথিন ও পস্নাস্টিক বর্জ্যের ফলে মাটি পানি দূষিত হয় এবং এতে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে জীবজগৎ ও উদ্ভিদকুল উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশেষভাবে। এ ছাড়া পস্নাস্টিক ও পলিথিনের দূষণের কারণে মাটির উর্বরতা ব্যাহত হয়, মাটিতে পতিত থাকা পলিথিন ও পস্নাস্টিক বছরের পর বছর অপচনশীল অবস্থায় পড়ে থাকে যার ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং বাস্তুতন্ত্রের সুস্থতা বিঘ্নিত হয়। পলিথিন ও পস্নাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে পরিবেশে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়, যার ফলে বায়ুদূষণ ঘটে এবং পরে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগব্যাধির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যা পরে দীর্ঘমেয়াদি রোগে পরিণত হয়।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ থেকে ১০ কেজি পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন করে। আর এই পস্নাস্টিক ও পলিথিনের একটি বড় অংশের শেষ গন্তব্য হয় নদনদী ও বিভিন্ন জলাশয়ে। আর জলাশয়ে পতিত হওয়ার কারণে জলাশয়ের নাব্যতা বাধাগ্রস্ত হয়। মাছসহ পানিতে বসবাসকারী প্রাণিকুল বিষাক্ত থাবায় মারা যায় নির্বিচারে। যার প্রভাব সরাসরি পরিবেশে বিদ্যমান। এ ছাড়া বিভিন্ন ডাস্টবিন ও অলিগলিতে অবাধে উচ্ছিষ্ট পলিথিন ও পস্নাস্টিক পড়ে থাকার কারণে এডিসবাহিত ডেঙ্গু জাতীয় মশার উৎপাদন হয়। যার ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
জার্মানভিত্তিক গবেষকদের নেটওয়ার্ক রিসার্চগেটে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী হয়ে প্রতি বছর প্রায় ১-৩ বিলিয়ন মাইক্রো পস্নাস্টিক মিশছে বঙ্গোপসাগরে। যার ফলে সাগরের পরিবেশ ও সাগর পাড়ের পরিবেশেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বিশেষভাবে। যার কারণে সমুদ্র তলদেশে মিশে গিয়ে সমুদ্র তলদেশ ফুলে ফেঁপে উঠছে।
পরিবেশ ধ্বংসকারী এই পলিথিন ও পস্নাস্টিক মাটির সঙ্গে যতই মিশুকনা কেন তা কোনো ক্রমেই গলিত হয় না। যার ফলে যুগ যুগ ধরে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে মাটির তলদেশ বা বিভিন্ন স্তরে। বাংলাদেশেরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো এখন নানা পণ্যসামগ্রী মোড়াচ্ছে পস্নাস্টিক বা পলিথিন জাতীয় বিশেষ কিছু দিয়ে। এক সময়ের কাচের বোতলে থাকা কোমলপানীয় এখন জায়গা দখল করে নিয়েছে পস্নাস্টিকের বোতলে। জুস, চিপস, বিস্কুট, মসলা, প্রশাধনী সবই এখন পস্নাস্টিকে মোড়া। চায়ের দোকান থেকে কাচের কাপ সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে পস্নাস্টিকের কাপ।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, মুদি দোকানের পণ্য বিক্রিতে ব্যবহৃত পস্নাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর। চা, কফি, জুস তথা কোমলপানীয়ের পস্নাস্টিক কাপের ক্ষেত্রে সময় লাগে ৫০ বছর। পস্নাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে গবেষকরা বলছেন পলিথিনের মতো পদার্থের যতই বয়স হোক না কেন তা মাটির নিচে অন্তত অবিকৃত থাকে প্রায় ৪৫০ বছর।
পস্নাস্টিক-পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে বোঝাতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমিয়ে যদি পাটের তৈরি ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ কিংবা বিকল্প কোনো পরিবেশবান্ধব ব্যাগসহ নানা ব্যবহার্য জিনিস ব্যবহার করা যায় তাহলে নদী ও সমুদ্র দূষণ যেমন বন্ধ হবে তেমনি আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশের উপাদানও ভালো থাকবে। বিশেষ করে দেশকে এমন তীব্রতা থেকে রক্ষা করতে হলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে লাগাতে হবে পরিবেশবান্ধব গাছ। যা থেকে আমরা সব সময় পাব সুশীতল ছায়া ও নির্মল ভেজাল মুক্ত বাতাস। যা আমাদের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করবে একশত ভাগ। আর এমন প্রত্যাশাই থাকবে সবার প্রতি ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি।