বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানিরা বলত, স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? পাট, চা ও চামড়া- এই তিন পণ্য রপ্তানি করে কি তোমাদের ভাত-কাপড় হবে? আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানিদের এ দোসর স্বাধীনতার পর বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি।' কিন্তু বাংলাদেশ যে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' নয়, উল্টো অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা দু'দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলনা করলেই প্রমাণ মেলে।
প্রকাশ | ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
সালাম সালেহ উদদীন
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নতি দেখে এখন লজ্জিত হই। কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। গত ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা করেন শাহবাজ শরীফ। তাদের তিনি বলেন, একাত্তর সালে আমি খুবই তরুণ ছিলাম। আমাদের বলা হতো বাংলাদেশ আমাদের ওপর একটি বোঝা। আজ সবাই জানেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ওই বোঝা কোথায় পৌঁছে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা এখন যখন বাংলাদেশের দিকে তাকাই লজ্জিত হই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যাচার করেছিল বলে স্বীকার করেছেন, দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি বলেছেন, নির্যাতন চালিয়ে বাংলাদেশের জন্ম ঠেকানো যায়নি। এই দুই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য শাহবাজ শরীফের ওপর চাপ রয়েছে। উলেস্নখ্য, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানের অংশ ছিল বাংলাদেশ। ওই সময় বাংলাদেশ 'পূর্ব পাকিস্তান' নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অংশ থাকা অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতেন এ অঞ্চলের মানুষ। শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে মুক্তিকামী মানুষ পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। টানা ৯ মাস যুদ্ধ করে '৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে দেশের বাঙালি নাগরিকদের বিরুদ্ধে চরম হত্যা নির্যাতনের পথ নিয়েও বাংলাদেশের অভু্যদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের মাত্র ২৪ বছরের মাথায় রক্তাক্ত এক যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ভেঙে যায় পাকিস্তান। অথচ বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় বেঙ্গল ছিল পাকিস্তানের একমাত্র অঞ্চল যেখানে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ দেশ সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার মানুষ সমান প্রতিনিধিত্ব পায়নি। এর প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গিয়েছিল আমলা এবং সেনাবাহিনীর হাতে। সেখানে গোষ্ঠী স্বার্থ ছিল প্রধান বিবেচনা। পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে নয় বছর লেগেছে। ফলে বৈষম্য ঘোচানোর আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিতেই বহু সময় চলে যায়। ১৯৭০-এ পাকিস্তানের দুই অংশ মিলে জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটির মতো। এখন ৩৮-৩৯ কোটি। বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ ভাগই একাত্তর দেখেনি। পাকিস্তানে নাগরিকদের ৮৯ ভাগের বয়স ৫০-এর কম। বাংলাদেশে একই বয়সসীমার নিচে আছে লোকসংখ্যার ৮৬ ভাগ। অর্থাৎ উভয় দেশে 'একাত্তর'-এর প্রত্যক্ষদর্শী আছে অতি অল্পজন। কিন্তু জাতীয়তাবাদ তুমুল এক আবেগের নাম- যা সব সময় তরুণ থাকে। ফলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে স্বাভাবিক ও সাবলীল করতে একাত্তরের সব অমীমাংসিত বিষয়ের ফয়সালা করে এগোনো উচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তান তা করেনি। একাত্তরের অপরাধের জন্য তারা বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি।
স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানিরা বলত, স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? পাট, চা ও চামড়া- এই তিন পণ্য রপ্তানি করে কি তোমাদের ভাত-কাপড় হবে? আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানিদের এ দোসর স্বাধীনতার পর বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি।' কিন্তু বাংলাদেশ যে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' নয়, উল্টো অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা দু'দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলনা করলেই প্রমাণ মেলে।
তা ছাড়া ধর্মীয় চরমপন্থা ও সন্ত্রাস মোকাবিলায় পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও ধর্মীয় চরমপন্থা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছে ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (ইএফএসএএস)। ব্যাপক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি মন্তব্য প্রতিবেদনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বীকৃত সংস্থাটি বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিবেশী পাকিস্তান যেখানে চরমপন্থি ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহ, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেখানে এদের দমনে বাংলাদেশের ভূমিকা যথেষ্ট ইতিবাচক। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ দমনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের রয়েছে জিরো টলারেন্স। তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ ব্যাপারে তৎপর ও মনোযোগী। যার কারণে সফলতা এসেছে। অথচ পাকিস্তানে টিএলপি সে দেশ থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক করতে তাদের সরকারকে বাধ্য করেছিল। সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রুগ্ন অর্থনীতির পাকিস্তানের প্রশাসন নাজুক অবস্থায় পড়েছে। মাথাপিছু আয়েও পাকিস্তানের দ্বিগুণ এখন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশ এখন অতিদ্রম্নত বিকাশমান একটি দেশ হিসেবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সব শর্ত পূরণ করে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ পর পর দু'টি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদন্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। সিডিপি তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে। আর পাকিস্তানের কথা বলাই বাহুল্য।
পাকিস্তানে অবশ্য কোনো কোনো মহলে এমন বিশ্বাস রয়েছে, হাজার মাইল দূরে ভারতঘেরা দেশের একটি অংশ যেখানকার মানুষের সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতির বহু অমিল সেটিকে অক্ষুণ্ন রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল।
বিভিন্ন দিক দিয়েই বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। অথচ এই বাংলাদেশের অগ্রগতির লাগাম টেনে ধরে রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। বিভিন্নভাবে তারা পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ করেছে। ৫৩ বছর পর সেই পাকিস্তান কেমন আছে এটা বিশ্ববাসী জানে? অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশ টিকতে পারবে না। সেই বাংলাদেশ পারমাণবিক বোমা ছাড়া আর্থসামাজিক সব সূচকে আজ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। আর পাকিস্তানে উন্নয়ন তো দূরের কথা অর্থনৈতিক সংকট পিছু ছাড়ছে না, রয়েছে রাজনৈতিক সংকটও। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। একাত্তরের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ বলব না, তবে এটা বলব যে, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের অনেক কিছু শেখার আছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের জন্য ব্রিটেনের রানি ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান আজো ক্ষমতা চায়নি একাত্তরের গণহত্যার জন্য। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি চর্চা করেছে। যার কারণে পাকিস্তানকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মানে এই নয় যে, একাত্তরের অপরাধের জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে না।
২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফরকালে এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে নওয়াজ শরিফ এসে একাত্তরের ঘটনাবলিকে বলেছিলেন 'রাজনৈতিক অনাচার'। এসব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বেদনাবোধের ন্যায্য স্বীকৃতি। কিন্তু এ রকম সাধারণ দুঃখ প্রকাশে একাত্তরের ক্ষত সারবে না। এরজন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক