শ্রমিকদের মর্যাদা ব্যতীত দেশ-জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়

আমাদের দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে 'মে দিবস' পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজও শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত শিল্পের বিকাশও সম্ভব নয়।

প্রকাশ | ০১ মে ২০২৪, ০০:০০

প্রফেসর মো. আবু নসর
আজ মহান ও ঐতিহাসিক মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক দিবস হিসেবে ১ মে সারা বিশ্বে 'মে দিবস' পালিত হয়। ১ মে দিবসের একটি ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। ঐতিহাসিক ও মহান 'মে দিবস' শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন। দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিকদের মর্যাদা অতি আবশ্যক। শ্রমিকদের মর্যাদা ব্যতীত দেশ ও জাতির উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোনো ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না নির্দিষ্ট সময়ের সীমা পরিসীমা। মালিকরা তাদের খেয়াল খুশিমতো শ্রমিকদের ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটাতো। ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস ও অন্যান্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করে। আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০০ শ্রমিক আহত হয়। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে'তে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অগণিত শ্রমজীবী মানুষ শ্রমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন এক দুর্বার আন্দোলন। সেই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্প কারখানাসহ সব শিল্পাঞ্চলে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘাটের ডাক দেয় শ্রমিকরা। শিকাগো শহরের 'হে' মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভের সমুদ্রে। শহরের ৩ লক্ষাধিক মেহনতি শ্রমিক কাজ বন্ধ রেখে লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়। এ সময় আন্দোলনরত ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর বিনা উস্কানিতে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে ওই দিনই নিহত হন ১০ জন শ্রমিক, আহত হন হাজার হাজার শ্রমিক। তবুও অব্যাহত থাকে ধর্মঘট ও আন্দোলন। এরপর ৩ মে রিপার কারখানার সামনে শ্রমিক সভায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আরও ৬ শ্রমিক। এসব হত্যার প্রতিবাদে ৪ মে শিকাগোর 'হে' মার্কেট স্কয়ারে স্মরণাতীতকালের বিশাল শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে আবারো বর্বরোচিত হামলা চালায় পুলিশ। ওই ঘটনায় ৪ জন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ নিহত হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় বহু শ্রমিককে। গ্রেফতারকৃত ৬ জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতু্যদন্ড প্রদান করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় আত্মহনন করেন এক শ্রমিক। কারাগারে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয় হাজার হাজার শ্রমিককে। দাবি আদায়ের জন্য সেদিন শ্রমিকদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল শিকাগোর রাজপথ। 'হে' মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধ যুদ্ধে এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব হয়। দীর্ঘদিন বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এই দিনে শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এক অপার উপাখ্যান। অবশেষে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২য় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে '১ মে'কে ঘোষণা করা হয় 'আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস' হিসেবে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে 'মে দিবস'। এক অর্থে সব শ্রমজীবী মানুষকে শ্রমিক বলা যেতে পারে। শুধু পরিবহণ, পোশাক কিংবা শিল্প-কলকারখানায় কাজ করা নিচের পদের মানুষকে শ্রমিক হিসেবে গণ্য না করে সব কায়িক পরিশ্রম করা মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। হোক সে দিনমজুর কিংবা চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী। সবাই শ্রম দিচ্ছে যার যার স্তরের শ্রমিক হিসেবে। শ্রমিক শব্দটি কোনোভাবেই এককেন্দ্রিক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। সমাজের নিচ থেকে ওপরমহল পর্যন্ত স্ব স্ব পেশায় সবাকেই শ্রমিক বলা যেতে পারে। আমাদের দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে 'মে দিবস' পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজও শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত শিল্পের বিকাশও সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ৯০-এর দশকের পরে যেসব ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হাজারো মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মূলত বিভিন্ন শিল্প-কারখানাকেন্দ্রিক। তন্মেধ্যে ২০০৫ সালে ১১ এপ্রিল সাভারের পলাশবাড়ির শাহরিয়ার ফেব্রিক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লি. ও স্পেকট্রাপ সোয়েটার ইন্ডাষ্ট্রিজ লি.-এর ভবন ধ্বসে ৬২ জন শ্রমিকের মৃতু্য, ২০১০ সালে ১ জুন ঢাকার তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ভবন ধ্বসে ২৫ জনের মৃতু্য হয়। ২০১০ সালের ৩ জুন ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে অগ্নিকান্ডে মারা যান ১২৪ জন, আহত হন কয়েক শত। ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের তলস্না এলাকায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃতু্যবরণ করেন ৩৪ জন মুসলিস্ন। তাদের মধ্যে অনেক শ্রমিকও ছিলেন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর তাজরিন পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ১১২ জন, সে সময় আহত হন ১৪১ জন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের সাভারের রানা পস্নাজা ভবন ও পোশাক তৈরি কারখানা ভবন ধ্বসে পড়ে। এতে ভবনের ৫টি পোশাক কারখানার ১১৩৮ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্যে অঙ্গ হারান ২৭ জন। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুর টাম্পকোয় টঙ্গীপুর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডে নিহত হন ৩৯ জন, আহত হন ৩৫ জন। ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার চকবাজারে চুরিপট্টির অহেদ ম্যানশনে অগ্নিকান্ডে মারা যান ৭১ জন, আহত হন অনেকে। ২০২১ সালের ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে পরদিন ৯ জুলাই শুক্রবার দুপুর ১২টায়। ওই ঘটনায় নিহত হন ৫২ জন শ্রমিক। পুরাতন ঢাকার চকবাজার ও বনানীর বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডে শ্রমিকসহ অনেকের প্রাণহানির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা আজো আমাদের নিদারুণভাবে শোকাহত ও বেদনাহত করে তুলেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুর, খুলনা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিকান্ড, ভবন ধ্বসসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবি, লঞ্চ অগ্নিকান্ড ও নানান শ্রমপেশার দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্ব স্ব পেশার শ্রমিকদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাই আজ নিহত ও আহত সব শ্রমিকদের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন অনস্বীকার্য ও অপরিহার্য। বস্তুত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির মূলে আছেন এ দেশের সৃজনশীল গরিব শ্রমিক। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া যেমন কারোরই কাম্য নয় তেমনি সবারই শ্রমিকবান্ধব হওয়াও বাঞ্ছনীয়। পরিবহণ শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার শ্রমিকসহ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব কর্মযজ্ঞতায় নিয়োজিত সব শ্রমিকদের সামগ্রিক স্বার্থ ও সঠিক মর্যাদা রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট মালিক পক্ষকে সব গাফিলতির ঊর্ধ্বে ওঠে এসে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানসহ শ্রমিকসেবা নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করা একান্ত প্রয়োজন। তবেই হবে মহান ও ঐতিহাসিক 'মে দিবস'-এর অঙ্গীকার পূরণ এবং 'মে দিবস'র যথার্থতা ও স্বার্থকতা। প্রফেসর মো. আবু নসর :অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ