চিরতরে বন্ধ হোক পস্নাস্টিকের ব্যবহার
বাংলাদেশও চাইছে এই ওয়ান টাইম পস্নাস্টিকের দূষণ থেকে বেরিয়ে আসতে। তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। পস্নাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আগামী জুনের মধ্যে সচিবালয়কে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকমুক্ত ঘোষণার উদ্যোগের অংশ হিসেবে সব মন্ত্রণালয়কে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এখন থেকে মন্ত্রণালয়ের নিমন্ত্রণ ও ভিজিটিং কার্ড, ফাইল ফোল্ডার ইত্যাদি লেমিনেটিং করা যাবে না। সভাকক্ষে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতল বা পরিবেশবান্ধব উপাদনসংবলিত পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতল ব্যবহার করতে হবে।
প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
অলোক আচার্য
একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে, হয় এখনই নয়তো কখনোই নয়। আমরা যদি পরিবেশ দূষণমুক্ত করে নিজেদের টেকসই ভবিষ্যত গড়ে তুলতে চাই তাহলে বাদ দিতে হবে ওয়ান টাইম পস্নাস্টিক দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার। এটা ঠিক যে তা একেবারে সহজ কথা নয় কিন্তু চাইলে তো কঠিনও নয়। পস্নাস্টিক বর্জ্য এবং পলিথিন নিয়ে পরিবেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। কিছু দেশ ইতিমধ্যেই একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। যে হারে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার বাড়ছে এবং যত্রতত্র ফেলে দিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছি তাতে সামনে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। তাই এখনই ভাবতে হবে আমরা কি করব। হুট করেই ব্যবহার করে আসা একটি জিনিস তালিকা থেকে বাদ দেওয়া সহজ নয় কিন্তু যখন আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তখন আস্তে আস্তে এর ব্যবহার কমে আসবে এবং এটাই একটি পরিষ্কার দেশ গড়তে সাহায্য করবে। যেমন যদি পানির বোতলের কথা বলি। এটা কি চাইলেই একদিনে বাদ দেওয়া সম্ভব? না, সম্ভব না। কিন্তু ধীরে ধীরে বাজারে এর বিকল্প এনে তারপর তুলে দিতে হবে। যখন পানির বোতল বাজারে ছিল না তখনো তো আমাদের চলেছে। ভারত ও কানাডার মতো দেশগুলোও একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৬০ সাল নাগাদ বিশ্বে পস্নাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে তিনগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই বছর জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক পস্নাস্টিকের বার্ষিক উৎপাদন ১০০ কোটি ২০ লাখ টন দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশও চাইছে এই ওয়ান টাইম পস্নাস্টিকের দূষণ থেকে বেরিয়ে আসতে। তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। পস্নাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আগামী জুনের মধ্যে সচিবালয়কে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকমুক্ত ঘোষণার উদ্যোগের অংশ হিসেবে সব মন্ত্রণালয়কে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এখন থেকে মন্ত্রণালয়ের নিমন্ত্রণ ও ভিজিটিং কার্ড, ফাইল ফোল্ডার ইত্যাদি লেমিনেটিং করা যাবে না। সভাকক্ষে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতল বা পরিবেশবান্ধব উপাদনসংবলিত পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতল ব্যবহার করতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন এক চিঠিতে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এসব নির্দেশনা দিয়েছেন। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ে পস্নাস্টিকের ব্যাগ, একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকের ছুরি, চামচ, পেস্নট, গস্নাস, বেলুন, খাবারের মোড়ক ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৫ জানুয়ারি থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এই ২০০ দিনের কর্মসূচিতে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়। দেশের শহরাঞ্চলে দৈনিক ৩০ হাজার টন মিশ্র কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে ১০ শতাংশ পস্নাস্টিক বর্জ্য। এই হিসেবে বছরে প্রায় ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন পস্নাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে দেশের শহরাঞ্চলে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার বরাত ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, পস্নাস্টিক বর্জ্যের ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়, ৩৯ শতাংশ ভাগাড়ে ফেলা হয়। বাকি ২৫ শতাংশ নদী ও সমুদ্রে পতিত হয়- যার পরিমাণ বছরে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮৫ টন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার সব ধরনের পস্নাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১০ বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে।
এই কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ পস্নাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল নিশ্চিত করতে চায় সরকার। আর ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আজকাল এর ব্যবহার এত বেড়েছে যে বলা চলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে পস্নাস্টিকের ব্যবহার। এর মধ্যে উলেস্নখ্যযোগ্য হলো সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিক। যার বিরুদ্ধে এখন মূলত সারা বিশ্বেই আলোচনা। সারা বিশ্বই যেন ক্রমশ সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের ওপর মহাবিরক্ত। অথচ এটা প্রথমে মানুষের জীবনযাত্রাকে একটু সহজই করেছিল! তারপর সেটিই মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদায় করতে পারলেই বাঁচা যায়। তবে চাইলেই সব দ্রম্নত হয় না। এখন আমরা চাইলেও খুব দ্রম্নত এসবের ব্যবহার রোধ করতে পারছি না। যেমনটা পারিনি পলিথিনের ব্যবহার ঠেকাতে। আইন করেও এর ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি। একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকের পণ্য মানুষের বেশ সুবিধা করেছিল। কিন্তু সেই সুবিধা যখন পরিবেশের ক্ষতি করতে লাগল তখনই সমস্যার উৎপত্তি। পস্নাস্টিকের একটি স্ট্র্র ব্যবহার করে আমরা যে ডাব খাচ্ছি তাও প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তরুণ এবং যুবজনগোষ্ঠী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পস্নাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। এর মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিক পণ্যই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যাবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব পস্নাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং পস্নাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পঁচে না। এভাবে একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিক ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। সাগর, নদী, পুকুর কোথাও পলিথিন ও পস্নাস্টিকের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাগরের মৃত প্রাণীদের পেটে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর পস্নাস্টিক- যা আমরা বিভিন্ন সময় সাগরের বুকে নিক্ষেপ করছি। একবারও ভেবে দেখছি না আমার ফেলে দেওয়া এই পস্নাস্টিক পণ্য প্রাণিকুলের জন্য সংকট বয়ে আনবে।
এক তথ্যে জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৯২ হাজার ১০৪ টন পরিমাণ পস্নাস্টিকের স্যাশে বা মিনিপ্যাক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। দেশের মানুষ দিনে প্রায় ১২ কোটি ৯০ লাখ পস্নাস্টিকের স্যাশে ব্যবহার করে। ২০২১ সালের ২১ জুন থেকে ২০২২ সালের ২২ মে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৬ হাজার টন ওয়ানটাইম পস্নাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকের বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যতে ভুগতে হবে। আমরা জেনেও ভুলে যাই যে পস্নাস্টিক কোনো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় না বরং এর প্রভাব এতটা মারাত্মক যে যুগের পর যুগ তা মাটিতে দিব্যি ঠিক থাকে। পস্নাস্টিক পঁচতে বহু বছর সময় লেগে যায়। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এর ব্যবহার কমার কোনো লক্ষণ নেই। এর ব্যবহার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে আজ পলিথিন যে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে তখন একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকও বুমেরাং হবে আমাদের জন্য। কেবল ভারত বা কানাডা নয় একবারের বেশি ব্যবহারযোগ্য নয় এমন পস্নাস্টিক ব্যাগ ও অন্য পণ্যের ব্যবহার কমানোর বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছিল চীন। আমাদের দেশেও এখন ওয়ান টাইম পণ্যের জয়জয়কার। বিয়ে, জন্মদিনসহ যে কোনো অনুষ্ঠানে এসব পণ্যের ব্যবহার চোখে পরে। আবার ব্যবহারের পর আশপাশেই সেগুলো ছুড়ে ফেলছি।
সারা বিশ্বেই একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং এর পরবর্তি পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এসব পস্নাস্টিকজাত পণ্যের একটি বড় অংশই সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন প্রথম প্রথম এসব একবার ব্যবহাযোগ্য পস্নাস্টিক আমাদের হাতে আসে তখন বেশ ভালো লেগেছিল। আজও ভালো লাগে। কারণ যখন কাঁচের কাপের বদলে হালকা পস্নাস্টিকের কাপে চা দেয় বিশেষভাবে এটা প্রচুর ব্যবহার হয়েছে করোনাকালীন। রাস্তায়, অলিতে গলিতে এসব কাপ পড়ে থাকতে দেখেছি। এখন সেসব কোথায় গেছে? নিশ্চয়ই ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে পৌঁছে গেছে? আবার বিয়ে বা এ রকম বড় কোনো অনুষ্ঠানে এক সময় ডেকোরেটর থেকে পেস্নট ভাড়া করেই বেশি আনা হতো। এখন দেখি সেখানে পস্নাস্টিকের থালা, গস্নাসের ব্যবহার করা হয়। তারপর অনুষ্ঠান শেষে পাশের কোনো ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়। এভাবেই চলছে শহর থেকে গ্রামে। কিন্তু এর ফল একবারও কি কেউ ভেবে দেখছি? এসব ওয়ান টাইম পস্নাস্টিকের গতি শেষ পর্যন্ত কি হচ্ছে? বেশিরভাগ মানুষই এ ব্যাপারে পুরোমাত্রায় অসচেতন। আর এ কারণেই সিঙ্গেল ইউজ পস্নাস্টিকের ব্যবহার না কমে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে চাই না পরিবেশ ধ্বংস করতে? ভবিষ্যতের পৃথিবী পরিচ্ছন্ন, টেকসই হবে না মানব জাতির জন্য ধ্বংসাত্মক হবে?
অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট