জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে প্রাকৃতি দুর্যোগ। ঘটছে প্রাণহানি, নষ্ট হচ্ছে সম্পদ, বিপন্ন হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি, বাড়ছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি। গত পাঁচ দশকজুড়ে জলবায়ু এবং আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মৃতু্য হয়েছে ২০ লাখেরও বেশি মানুষের। হতাহতদের ৯১ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশের। প্রতিনিয়ত এটি আরও তীব্রতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত ৫০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপর্যয়ের সংখ্যা ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে, মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চরম আবহাওয়া কৃষি, অর্থনীতি এবং মানুষের সুস্থতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুর্বল গোষ্ঠীর মানুষ, যেমন যাদের স্বাস্থ্য দুর্বল বা সহায়-সম্পদের অভাব রয়েছে তারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। গত ছয় বছরে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ফসলের ফলন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে- যার ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। আর এরকম জলবায়ুর প্রভাবজনিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে প্রচ্ছন্ন ও বিপজ্জনক দুর্যোগ হলো ভূমিকম্প। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঝড় কিংবা সুনামির অগ্রিম সতর্কবার্তা বা পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হলেও ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে তার কোনো সুযোগ নেই। ভূমিকম্প হলো ভূ-অভ্যন্তরে শিলাগুলোর মাধ্যাকর্ষণ সমতার আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে ক্ষণিকের জন্য ভূ-পৃষ্ঠে অনুভূত কম্পন। বিজ্ঞানীদের মতে, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সাধারণত ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার গভীরে এ ধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়ে থাকে। ১৮০০ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ প্রকৌশলী জন মাইকেল সর্বপ্রথম ভূমিকম্পের কারণ উদ্ঘাটন করেন। তিনিই হলেন ভূকম্পনবিদ্যার জনক। তার মতে, ভূ-পৃষ্ঠের বহু নিচে শিলাখন্ডের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, ভূমিকম্পের সঙ্গে বিশাল পরিমাণ শক্তি জড়িত থাকলেও ভূ-পৃষ্ঠে প্রতি বছর যে ৮ লাখ ৫০ হাজার বার ভূমিকম্প হয়ে থাকে, তার মধ্যে ২০টিরও কমসংখ্যক ভূমিকম্প যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করে থাকে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১০০টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, যেগুলোর বেশিরভাগই তিন থেকে চার দশমিক পাঁচ মাত্রার ক্ষুদ্র কম্পন ছিল। ইউএসজিএস ও ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, এদের মধ্যে পাঁচটি ছিল পাঁচ বা তার বেশি মাত্রার। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে মিনিটে ভূমিকম্প হচ্ছে।
আর এই ভূমিকম্পের পেছনে বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। যদিও এতদিন এ বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কারণ, ভূমিকম্প সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ভূমিকম্প পৃথিবীর পৃষ্ঠের নিচে টেকটোনিক পেস্নটের নড়াচড়ার কারণে ঘটে। আর জলবায়ু পরিবর্তন বলতে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং অন্যান্য বায়ুমন্ডলীয় অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনকে বোঝায়। কিছু গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন পরোক্ষভাবে নির্দিষ্ট ধরনের ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতাকে প্রভাবিত করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ এবং বরফের শিট গলে যাওয়া পৃথিবীর ভূত্বকের উপর চাপ উপশম করতে পারে- যা সম্ভাব্য কিছু অঞ্চলে আগ্নেয়গিরি এবং ভূমিকম্পের কার্যকলাপ বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। এছাড়াও, বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনের কারণে ভূগর্ভস্থ জলের স্তরের পরিবর্তনসমূহ ত্রম্নটিগুলোর ওপর চাপকেও প্রভাবিত করতে পারে এবং সম্ভাব্য ভূমিকম্পের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে। সামগ্রিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে কিছু সম্ভাব্য পরোক্ষ সংযোগ থাকলেও, ভূমিকম্পগুলো প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের পরিবর্তে টেকটোনিক শক্তি দ্বারা চালিত হয়। বিশ্বে শেষবার গুরুতর উষ্ণায়নের অভিজ্ঞতা হয়েছিল গত বরফ যুগের শেষের দিকে প্রায় ২০,০০০ থেকে ১০,০০০ বছর আগে, যখন তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছিল, এতে মহাদেশীয় বরফের শিটগুলো গলেছিল এবং সমুদ্রের স্তরকে ১২০ মিটারেরও বেশি ঠেলে দিয়েছিল। এই বিশাল পরিবর্তনগুলো ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। কিলোমিটার-পুরু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বরফের শিটটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, নিচের ত্রম্নটিগুলো সহস্রাব্দের জমা হওয়া স্ট্রেনকে ছেড়ে দেয়, ফলে বিশাল আট মাত্রার ভূমিকম্পের জন্ম দেয়। প্রশান্ত মহাসাগরের 'রিং অব ফায়ার' এর চারপাশে এই স্কেলের কম্পন দেখা দেয়। এই মুহূর্তে পৃথিবী এখনো প্রায় ২০ হাজার বছর আগে শেষ হওয়া বরফ যুগের শেষের দিকে সারা দিচ্ছে। ভূতাত্ত্বিক ম্যাকগুয়ারের বলেন, যদি মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন গ্রিনল্যান্ডের মতো বড় বরফের শিটগুলোকে অদৃশ্য করে দেয় তবে এটি আরও ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
নাসার বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে গলে যাওয়া হিমবাহ কয়েক দশক ধরে আলাস্কায় ভূমিকম্প ঘটাচ্ছে। এই প্রভাব শুধু উত্তর মেরুতে সীমাবদ্ধ নয়। গলতে থাকা হিমবাহ পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপরিভাগজুড়ে ওজন বণ্টনের যে হিসাবটি ছিল, তা বদলে দিচ্ছে। ফলে গ্রহের টেকটোনিক পেস্নটে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটছে- যা আরও ভূমিকম্প ঘটাতে পারে, জাগিয়ে তুলতে পারে আগ্নেয়গিরিকে, এমনকি পৃথিবীর অক্ষরেখার নড়চড়কেও প্রভাবিত করতে পারে।
এক গবেষণায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট পরিণতি 'আমাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকম্প অস্থিরতা বিষয়ে সতর্ক করছে।'
গত কয়েক দশক ধরে গবেষকরা ভূতাত্ত্বিক সময়ের (১ থেকে ১০০ মিলিয়ন বছর) ওপর পর্বতশ্রেণির প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিবর্তনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। উদ্দেশ্য হলো ক্ষয়, অবক্ষেপণ এবং টেকটোনিক বিকৃতির প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে গতিশীলতা এবং মিথস্ক্রিয়াগুলো আরও ভালোভাবে বোঝা। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ভূপৃষ্ঠের ক্ষয় এবং অবক্ষেপণ অগভীর ভূমিকম্পের সূত্রপাত ঘটাতে পারে (পাঁচ কিলোমিটারেরও কম গভীরে) এবং ভূ-পৃষ্ঠ বড় ধরনের ভূমিকম্পে ফেটে যেতে পারে। আর এই ভূমি ক্ষয় ও অবক্ষেপণ পেস্নট টেকটোনিক্সকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কারণ ভূ-পৃষ্ঠের এই প্রক্রিয়াগুলো পেস্নট টেকটোনিক্সের সক্রিয় ত্রম্নটিগুলোর ওপর চাপ বাড়ায়। এইরূপ চাপের কেন্দ্রবিন্দুর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প অঞ্চল তাইওয়ান। তাইওয়ানে ভূমি ক্ষয় এবং বিকৃতির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। গবেষকদের মতে, প্রতি বছর এই হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০ মিলিমিটার। এই ধরনের শক্তি সম্ভবত অগভীর ভূমিকম্পের জন্য যথেষ্ট (পাঁচ কিলোমিটারেরও কম গভীরে) বা ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত গভীর ভূমিকম্পের ফাটল ধরে রাখার পক্ষে, বিশেষ করে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে চরম ক্ষয়জনিত ঘটনা দ্বারা প্রসারিত হয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, পেস্নট টেকটোনিক্স একমাত্র স্থায়ী প্রক্রিয়া নয়- যা ভূমিকম্পের ত্রম্নটিগুলোর কার্যকলাপকে প্রভাবিত করতে সক্ষম, এবং ক্ষয় ও অবক্ষেপণের মতো ভূ-পৃষ্ঠের প্রক্রিয়াগুলো অগভীর ভূমিকম্প ঘটাতে সক্রিয় ফল্টগুলোর ওপর যথেষ্ট চাপ বাড়াতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, পৃথিবীর পৃষ্ঠ মাত্র কয়েকদিন, মাস বা বছরের মধ্যে বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে এবং ঘটতে পারে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো চরম ঘটনা।
অষ্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক বলেছেন, মৌসুমি বৃষ্টি প্রতি বছর উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়- যা ভারতীয় পেস্নটের গতি বছরে এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। গ্রীষ্মকালীন বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ভূত্বককে উলম্ব এবং আনুভূমিকভাবে একসঙ্গে সংকুচিত এবং স্থিতিশীল করে। যখন বৃষ্টির পানি শীতকালে কমে যায়, তখন কার্যকরী 'প্রতিক্ষেপণ' অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে এবং ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়।
প্রাচীন পৃথিবীর গতিবিধি, নদীর গতিপথে আকস্মিক ও বিপর্যয়কর পরিবর্তন এবং গভীরভাবে চাপা পড়ে থাকা সক্রিয় ফল্টের উপস্থিতির প্রমাণের ভিত্তিতে, বেশ কিছু ভূকম্পবিদ নির্ধারণ করেছেন যে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য পরবর্তী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কয়েক বছর আগেই ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নিয়ে আগাম বার্তা দিয়েছিলেন ভূকম্পবিদ লিওনার্দো সিবার। বাংলাদেশে অনেক সক্রিয় টেকটোনিক পেস্নট সীমান্তের সংযোগস্থলে (সিলেট ও চট্টগ্রাম) অবস্থিত। তাছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের সান্নিধ্য এবং বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপের অবস্থান এ দেশকে সুনামি এবং ভূমিকম্পের মতো ভয়ানক দুর্যোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর টেকটোনিক পেস্নটের ঘূর্ণনকে প্রভাবিত করতে পারে- যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই বাংলাদেশকে আসন্ন ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট