২৮ এপ্রিল, শহীদ শেখ জামালের ৭১তম জন্মদিন। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিবের দ্বিতীয় পুত্র, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই। তিনি ছিলেন তরুণ দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সেনা কর্মকর্তা। ১৯৫৪ সালের এদিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন, দিনের বেশিরভাগ সময়ই পড়াশোনায় ডুবে থাকতেন। পড়ালেখার বাইরে খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চায় বিশেষ মনোযোগ ছিলেন। সংস্কৃতির সাধক হয়ে ওঠা শেখ জামাল ছায়ানটে গিটার বাদক ছিলেন। খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণটা পারিবারিকভাবেই পেয়েছেন। পিতা বঙ্গবন্ধু ও পিতামহ উভয়ই ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন ভালো ক্রিকেটার। প্রথম শ্রেণির লিগে নিয়মিত খেলতেন। শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ছিল অনেক ঘটনাবহুল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারের পর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও পাকিস্তানিদের হাতে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোড়ের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি ছিলেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ৫ আগস্ট সকালে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তার যাওয়াটা অত সহজ ছিল না।পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রহরা থেকে পালানোর সময় ধরা খেলে মৃতু্য অনিবার্য ছিল। ভারতের আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছে যান। সেখানে মুজিব বাহিনীর বাছাইকৃত ৮০ জন নির্বাচিত তরুণ সদস্যের সঙ্গে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয় যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েন। যোগ দেন ৯নং সেক্টরে। যুদ্ধে অনেক দুঃসাহসিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যেসব আলোকচিত্র আসে তার একটিতে সীমান্তের ১০ মাইল ভেতরে একটি রণাঙ্গনে সাবমেশিনগানধারীদের একজন হিসেবে ছবি ওঠে শেখ জামালের। শেখ জামাল ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক মেধাবী সেনা অফিসার। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশের সেবা করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্স'র প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার। ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যুগোস্স্নোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশ সফর কালে শেখ জামালের সেনাবাহিনীতে কাজ করার আগ্রহ দেখে টিটো তাকে যুগোস্স্নাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন সে প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি যুগোস্স্নাভিয়ার ক্যাডেট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান। এরপর ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসস্থ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে দেড় মাস সময়ের চাকরিকালে অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে তিনি অসাধারণ পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহেই শেখ জামাল অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাদেরই একজন হয়ে যান। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে, রণকৌশলের ক্লাসে, অবস্টাকল ক্রসিংয়ে অংশ নিয়ে সৈনিকদের মুগ্ধ করেন। ব্যাটালিয়ন বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। বিকালে ইউনিট সদস্যদের নিয়ে খেলতেন বাস্কেট বল। সকালে পিটির সময় সবাইকে দৌড়ে পেছনে ফেলে অবাক করে দিতেন। ১৪ আগস্ট রাতে ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাতে ফিরে আসেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। ভোর রাত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের শিকার শেখ জামালসহ তার পরিবার। এভাবেই থেমে যায় এই ২১ বছরের টগবগে তরুণের জীবনের আলো। জাতির জনকের পূত্র, একজন রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়েও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই সেনাবাহিনীর চাকরি করেছিলেন। অথচ সেই সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল কুলাঙ্গার সদস্যদের হাতেই তাকে শহীদ হতে হলো। তখন তিনি ছিলেন ক্যাপ্টন পদমর্যদার অফিসার। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের হত্যার বিচার সেনা আইনে করতে ব্যর্থ হয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনী। শেখ জামাল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এখনো তরুণ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখায় শহীদ শেখ জামাল। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে তৈরি হয়েছে শেখ জামাল ইনানী জাতীয় উদ্যান (কক্সবাজার), শেখ জামাল টেনিস কমপেস্নক্স (রমনা, ঢাকা), শেখ জামাল স্টেডিয়াম (ফরিদপুর), শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব (ঢাকা), শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ক্রিকেট দল (ঢাকা), শহীদ শেখ জামাল যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ আরো বহু প্রতিষ্ঠান। আজকের এই দিনে দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা, সুদক্ষ মেধাবী সেনা অফিসার শেখ জামালকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন শহীদ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল।