সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর মিছিলের শেষ কোথায় তা আমাদের জানা নেই। ট্রাফিক শৃঙ্খলার অভাবে ঘটছে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা। সব সম্ভবের এই দেশে মহাসড়ক বা হাইওয়েগুলোতেও চলে নসিমন, করিমন ও অটোরিকশার মতো যানবাহন। সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তার মধ্যে অন্যতম হলো- আইন অমান্যের প্রবণতা। যানবাহন চালক, পথচারী সবার মধ্যে এ প্রবণতা ক্রিয়াশীল।
সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টানতে হলে যেমন ইচ্ছা তেমন চলার প্রবণতায় বাঁধ সৃষ্টি করতে হবে। মোটর সাইকেলের ফ্রি-স্টাইল চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা দরকার। সবচেয়ে আগে কী কারণে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তা উদ্ঘাটন করে মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, সড়কে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এজন্য লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা দরকার। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ যাতে যান্ত্রিক যানবাহন চালাতে না পারে সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে। যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের সম্পর্ক নিয়ে যে রটনা রয়েছে তার ইতি ঘটানোও 'জরুরি।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক প্রাণ ঝরবে তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। হতাহতের মিছিল আর দীর্ঘায়িত করতে না চাইলে যানবাহনে চালক, যাত্রী, পথচারী এবং ট্রাফিকব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে যারা জড়িত তাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। জনসচেতনতা গড়ে তোলাও জরুরি। এক্ষেত্রে ঘাটতি আছে বলেই সড়কে বাড়ছে মৃতু্যর মিছিল। তা যেভাবেই হোক এ দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে হবে।
নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও প্রতিদিনই দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত মাসিক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে গত মার্চে ৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ২২৮ জন।
সারা বছর যতসংখ্যক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, তার প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশের মৃতু্য হয় শুধু ঈদের সময়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন ঈদুল ফিতরে মোট ৯৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৭ জনের মৃতু্য হয়েছে। এই সময়ে ঈদুল আজহায় ৭৮৬টি দুর্ঘটনায় ৭৭০ জনের প্রাণ ঝরেছে সড়কে। গত মঙ্গলবার ফরিদপুরসহ সাত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃতু্য হয়েছে। ঈদের দিনই সারাদেশে ২১ জনের মৃতু্য হয়েছে।
গত বুধবার ঝালকাঠিতে একটি সিমেন্টবোঝাই ট্রাকের চাপায় দুমড়েমুচড়ে গেছে একটি প্রাইভেট কার ও তিনটি অটোরিকশা। এ ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১২ জন। এ ছাড়া দেশের তিন জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে আরও চারজন।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিকে শুধুই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশের সড়ক-মহাসড়কে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকান্ড বলা যায়। অনেক দুর্ঘটনাই চালকের কারণে ঘটে থাকে। অনেক চালক রাত-দিন গাড়ি চালান। অত্যধিক ক্লান্তি এবং গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।
লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকের হাতে, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেওয়া হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আমাদের দেশে চালকদের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা। চালকদের মাদকাসক্তিও সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ। মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধে চালকদের ডোপ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা কি মেনে চলা হচ্ছে? সেই সময়ে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ থেকে জানানো হয়েছিল চালকরা মাদকাসক্ত কিনা, তা রাস্তায়ই পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষায় কোনো চালক ধরা পড়লে তাকে সরাসরি জেলে পাঠানো হবে। চালকদের সেই ডোপ টেস্ট কত দূর?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে অপরিকল্পিত স্পিডব্রেকার বা গতিরোধকগুলোও দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের পাশে হাটবাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে একই সঙ্গে জনগণকেও হতে হবে সচেতন।
সরকারি-বেসরকারি ও নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে চার হাজার মানুষের মৃতু্য হয়। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও প্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। দেখা গেছে, বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা হলে, বিশেষ কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনায় নিহত হলে বা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সড়কে আন্দোলন দেখা দিলে কিছুদিন প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। কিছু আলোচনা, কিছু সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখে না।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। আর্থসামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ দু'টি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এছাড়া উন্নত পরিবহণব্যবস্থা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। সুতরাং, উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহণব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা ও কাজ এখনই শুরু করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ ফিটনেসহীন যানবাহন। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আমরা চাই, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সব ব্যবস্থা নেওয়া হোক। চালকদের ডোপ টেস্ট করে প্রয়োজনে নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হোক।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ