তীব্র তাপপ্রবাহ ও জনসচেতনতা

তাপপ্রবাহকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দুর্যোগ হিসেবে দেখতে হবে। বিষয়টি সমাজ, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন ও পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, এর সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট কুকীর্তিও জড়িত। নির্বিচারে বন উজাড়, গাছ কাটা, নদী খাল ভরাট ও দখল করার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমরা যদি আমাদের পরিবেশের দিকে নজর না দিই তা হলে আগামী বছরগুলোতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী আরও গভীর সংকটে পড়বে। সুতরাং, সময় থাকতেই সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি।

প্রকাশ | ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন

তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে সারাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষ। গ্রীষ্মে বাংলাদেশে প্রচন্ড গরমের দিনের সংখ্যা বাড়ছে। দেশজুড়ে চলা তাপপ্রবাহের কারণে দেশের সব স্কুল-কলেজ সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবীদের কালো গাউন পরার আবশ্যকতা শিথিল করা হয়েছে। ঢাকাসহ ৪৫টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। আপাতত তাপপ্রবাহ কমার সম্ভাবনা না থাকায় নতুন হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। দেশের মানুষকে তিন দিন সতর্কতায় থাকতে বলছে প্রতিষ্ঠানটি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। শনিবার তা কয়েক জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহে রূপ পায়। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে মেহেরপুর, সিলেট ও নরসিংদীসহ কয়েক জেলায় হিটস্ট্রোকে ৩০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। মানুষের ভেতরে স্বস্তি ও শান্তি নেই, ভয় ও ঝুঁকি কাজ করছে। প্রচন্ড গরম আবহাওয়ার কারণে জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। গরমে তিনগুণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হিটস্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সব বয়সের মানুষের কষ্ট হলেও এই গরম সবচেয়ে বেশি কাবু করেছে শিশুদের। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশই শিশু। তাই গরমে সুস্থ থাকতে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সুতি কাপড় পরা এবং বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এটা সত্য, শিশুরা বড়দের মতো আবহাওয়ার দ্রম্নত পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। গরমের সময় সাধারণত জ্বর, ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা, ডিহাইড্রেশন; অর্থাৎ শরীরে পানিশূন্যতা বা স্বল্পতা রোগী বেশি দেখা যায়। গরমের এ পরিস্থিতিতে ফলের শরবত, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন, গস্নুকোজ ও পুষ্টিকর রসাল ফল বেশি করে খেতে হবে। এতে শরীর থেকে ঘাম হয়ে বের হয়ে যাওয়া পানির চাহিদা পূরণ হবে। তবে গরমের কারণে ঠান্ডা পানি, বরফ কিংবা রাস্তার পাশের বিভিন্ন ধরনের শরবত এবং খোলা খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। শিশুদের এই গরমে ঢিলেঢালা পোশাক ব্যবহার করতে হবে, নিয়মিত গোসল করাতে হবে। এ সময় বাচ্চাদের অবশ্যই ফুটানো পানি ও ফ্রেশ খাবার খাওয়াতে হবে। এখানে উলেস্নখ করা প্রয়োজন, ১৯৬১ সালের দিকে বছরে এ রকম সাত দিনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষকে। এখন সেই কষ্টের দিনের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ থেকে ২১। অধিক তাপমাত্রা জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ওপর প্রভাব হঠাৎই পড়ে। তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানোর আগেই সতর্ক হওয়া উচিত। মানুষ ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কিছু সময় পার করলেই তার শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এটিই জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। বাস্তবতা হচ্ছে, গরম আবহাওয়ার কারণে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে যায়। শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে লবণজাতীয় পদার্থ বের হয়ে যায়। শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। মানুষ অজ্ঞান হয়, খিঁচুনি দেখা দেয়। পরিস্থিতির বেশি অবনতি ঘটলে কিডনি ও ফুসফুসের ক্ষতি হয়, মানুষ মারাও যেতে পারে। এপ্রিল বাংলাদেশের উষ্ণতম মাস। এ মাসে গরমের পাশাপাশি কালবৈশাখীরও দাপট থাকে বেশি। সঙ্গে বাড়ছে রোগবালাই। সুতরাং, সতর্ক ও সচেতন হওয়াই সঙ্গত। ঘর থেকে বের হলেই যেন মরুভূমির লু হাওয়া। অতিরিক্ত তাপে গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ। জনজীবন বিপর্যস্ত। গত দুই বছরের মতো এবারও এপ্রিল মাস যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এক সময় রাজশাহী বিভাগ ও খুলনা বিভাগের একাংশে গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম পড়ত। আর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে গরমের কষ্ট ছিল বেশি। গত ১০ বছরে দেশের ৮০ শতাংশ এলাকাজুড়ে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত থেমে থেমে তাপপ্রবাহ বইছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও ভোগান্তি তৈরি করছে এ মাসের বেশিরভাগ সময়জুড়ে বয়ে যাওয়া অতি উষ্ণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা- যা 'ওয়েট বাল্ব গেস্নাব টেম্পারেচার' নামে পরিচিত। এ ধরনের উষ্ণ আবহাওয়া বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগে রূপ নিতে শুরু করেছে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে গেছে। গড়ে সারাদেশের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে শুধু তাপমাত্রার তীব্রতা দিয়ে মানুষের কষ্ট ও বিপদ বোঝা যাবে না। কোথাও তাপপ্রবাহ অর্থাৎ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না গেলেও বিপজ্জনক আবহাওয়া তৈরি হতে পারে। কোথাও যদি তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে এবং আর্দ্রতা ৪০ শতাংশের বেশি হয় এবং বাতাসের প্রবাহ কম থাকে, তাহলে সেখানে অতি উষ্ণতায় বিপদ তৈরি হতে পারে। এপ্রিল মাসজুড়ে বাংলাদেশে এই অতি উষ্ণতার বিপদই তৈরি হচ্ছে। গত ৬০ বছরে এপ্রিলের উষ্ণতা দ্রম্নত বেড়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। উচ্চ তাপমাত্রা শহরে খাওয়ার পানি ও বিদু্যতের সংকট তৈরি করছে। এ ছাড়া ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া এবং খরা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মানুষের মেজাজ খিটখিটে হওয়া এবং সামাজিক অশান্তি তৈরির ক্ষেত্রেও ওই অতি উষ্ণতা ভূমিকা রাখছে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সময়ের জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও গবাদিপশুর সুরক্ষার জন্য দ্রম্নত পরিকল্পনা নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ২০২৩ সালে এশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগবিধ্বহমশ অঞ্চল। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ এই তথ্য জানিয়েছে। বন্যা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই অঞ্চলে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রধান কারণ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। গত বছর বৈশ্বিক তাপমাত্রা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এশিয়া অতিমাত্রায় দ্রম্নতগতিতে উষ্ণ হচ্ছে। এশিয়ায় তাপপ্রবাহের প্রভাব তীব্রতর হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি গলে যাওয়া হিমবাহগুলো এই অঞ্চলের পানির নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাপপ্রবাহকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দুর্যোগ হিসেবে দেখতে হবে। বিষয়টি সমাজ, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন ও পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, এর সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট কুকীর্তিও জড়িত। নির্বিচারে বন উজাড়, গাছ কাটা, নদী খাল ভরাট ও দখল করার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমরা যদি আমাদের পরিবেশের দিকে নজর না দিই তা হলে আগামী বছরগুলোতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী আরও গভীর সংকটে পড়বে। সুতরাং, সময় থাকতেই সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক