শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বৃদ্ধি শিক্ষকের নৈতিক অবক্ষয়
শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়টিতে সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার
পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকেই শিক্ষকতা ও শিক্ষক শব্দটি সবচেয়ে সুন্দর হিসেবেই মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। এখনো যে একবারেই নষ্ট হয়ে গেছে তা কিন্তু বলা যাবে না। হঁ্যা, এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে কিছু সংখ্যক নামধারী শিক্ষকের জন্য শিক্ষক সমাজ আজ সাধারণ মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে। শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিতে অনেকটা ভাটা পড়েছে- যা শিক্ষক সমাজকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। শিক্ষাদানের মহান ব্রত নিয়ে যারা কাজ করেন তারাই শিক্ষক। সেটা হোক প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক শব্দটি বিভিন্ন ভালো ভালো শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। শিক্ষক হতে হলে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে জরুরি তা হলো শিষ্টাচার, ক্ষমাশীল ও কর্তব্যপরায়ণ এর মতো কিছু বিশেষণ। অন্যভাবে সত্যবাদী, শিক্ষিত, চরিত্রবান, সৎ, উদ্যোগী ও দায়িত্ববান শব্দের মতো কিছু সুন্দর শব্দের সমাহার ঘটবে শিক্ষকের জীবনে। ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তবে সমাজের অন্যান্য মানুষের তুলনায় শিক্ষক সমাজের নিকট মানুষের চাহিদা অনেক বেশি এটা মনে রাখতে হবে শিক্ষক সমাজকে। এখনো সাধারণ মানুষ ও অভিভাবকরা শিক্ষকদের আস্থার পাত্র হিসেবেই দেখে এবং পিতামাতার পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়ে থাকে। কেননা, একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার অনুসারীদের জ্ঞান ও ন্যায় দীক্ষা দিতে। একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষার্থীদের মানবতাবোধ জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থক করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেন। সুন্দর পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারিগর শিক্ষক। সুন্দর মানুষের জন্ম না হলে দেশের অগ্রযাত্রা থেমে যাবে। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদের দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। পৃথিবীতে যারা জ্ঞান ও কর্মে বড় হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের জীবনেই শিক্ষকের প্রভাব অনস্বীকার্য। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যৌন হেনস্তার ঘটনা জাতিকে চরম অস্বস্তিতে ফেলছে। শিক্ষকদের দ্বারা একের পর এক ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অশালীন নাচের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, এমন কী বাদ যাচ্ছে না শিক্ষার্থীরাও। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রম্নত ছড়িয়ে যাচ্ছে সব জায়গায়। যার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আর হতাশার কথা হলো ছড়িয়ে পড়া ছাড়াও আরও অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে- যা ভুক্তভোগী পক্ষ নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা এবং ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে প্রকাশ হচ্ছে না আরও নির্যাতনের ঘটনা। এসব ঘটনা শিক্ষকদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন ও অধঃপতন বলা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে এখন ভাইরাল হচ্ছে দ্রম্নত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব ঘটনার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যা পরিসংখ্যান বলছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যখন অবস্থান করে তখন জীবনের পটপরিবর্তনের সময়। আর পরিবর্তনের সময় জীবনের নানা ঘটনা জন্ম নিতে থাকে। এসব ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীর মৃতু্য পর্যন্ত ঘটছে। তৈরি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা। বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ, অবনতি হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। ঘটনার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম্বার দেওয়ার প্রলোভনে। এই নাম্বার দেওয়ার ফাঁদে ফেলে শিক্ষার্থীর ওপর নেমে আসে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব প্রকাশিত হয় খুব কমই। বিভিন্ন কারণে কেউ প্রকাশ করে, আবার কেউ কেউ করতে পারে না। শেষ পর্যায়ে যখন প্রকাশিত হয় তখন এটা অনেক দূরে চলে যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারের নিয়ম নীতির ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর ওপর থেকে শাসন নামক শব্দটির অপমৃতু্য হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের ব্যবধান কমাতে গিয়ে সম্পর্ক এতটা তলানিতে এসেছে যে, তা বলাই কঠিন। এই স্তরের শিক্ষার্থীরা যখন ওপরের স্তরে প্রবেশ করছে তখন এই সম্পর্ক কিছু কিছু ক্ষেত্রে জটিল আকার ধারণ করছে। এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। তবে মাঠের বাস্তবতা এ থেকে দূরে নয়। সম্প্রতি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বিষয়গুলো যখন সামনে আসে তখন আমরা খুব উদ্বিগ্ন হই। কিছুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর আবার আগের জায়গায় ফিরে যাই আমরা। এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন চলে আর বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমিটির প্রতিবেদন আর প্রকাশিত হয় না। লোকলজ্জার ভয়ে মেয়ের পরিবার সেটা আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে থাকে না। অন্যদিকে, চলে প্রভাবশালী পরিবারের হুমকি। সব মিলিয়ে ফলাফল শূন্য। এমনকি বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত শিক্ষকদের বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন পথ অনুসরণ করে থাকেন। যখন আর বাঁচানোর কোনো পথ থাকে না তখনই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রতিটা ঘটনা আলাদা আলাদা বিচার করলে দেখা যাবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের গাফিলতির কারণে এসব অভিযুক্তদের সঠিক বিচার করা যাচ্ছে না। সিরডাপ মিলনায়তে 'যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতে নির্দেশনা : বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়' র্শীষক মতবিনিময় সভায় বস্নাস্টের গবেষণা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত ১৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টি (৬১ শতাংশ) বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭টি। ৬২টি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কমিটি গঠন করেনি। তার মানে বিষয়টি হলো কোনো ঘটনা ঘটার আগে কেউ কমিটি করতে রাজি নয়। বিচার না করে কেবলই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক সব প্রতিষ্ঠানেই যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সম্পর্কিত কমিটি রয়েছে। তবে এসব কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মাঝে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যে সম্পর্ক দেখা যেত এখন সেটি আর নেই বললেই চলে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই এ বিষয়টি নিয়ে বেশি বেশি সেমিনারের আয়োজন করা এখন জরুরি এবং সরকারের কিছু নীতির পরিবর্তন করা সময়ের দাবি।
শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়টিতে সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক