একটি দুর্ঘটনাও আর না ঘটুক, আর না হোক সারা জীবনের কান্না : 'একটা দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না'- এ স্স্নোগানটি নির্মম বাস্তবতার উদাহরণ। আজকাল আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন টিভির পর্দায় আর পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনার মর্মান্তিক খবর। এতে কত মূল্যবান তাঁজা প্রাণ অকালে ঝরে পড়ছে, কত পরিবার পথে বসছে কত স্বপ্ন রাস্তায় পিষে যাচ্ছে। সেই অশ্রম্নসজল করুণ মুখের হিসাব কেউ রাখে না। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্রের সামনে পিতার রক্তাক্ত নিথর দেহ, কিংবা জন্মগ্রহণ করে ঠিকভাবে পৃথিবীটাই জানল না সেই মায়ের কোলের বাচ্চাটি অকালেই প্রাণ হারাল। এই অনাকাক্ষিত মৃতু্য মেনে নেওয়া যায় না।
২০২৩ সালে জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত দুর্ঘটনার প্রতিবেদন :
গত ২০২৩ সালে প্রথম আলোতে প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে (বিআরটিএ সূত্রানুযায়ী) দেখা যায়, প্রথমবারের মতো সড়কে মৃতু্যর বার্ষিক হিসাব প্রকাশ করেছে সরকারি সংস্থা বিআরটিএ। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দিনেই গড়ে মৃতু্য হচ্ছে ১৪ জনের। বিআরটিএর হিসাব মতে ৫,০২৪ জন, পুলিশের হিসাবে ৪,৪৭৫ জন, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬,৫২৪ জন, যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ৭,৯০২ জন নিহত হন।
এই দুর্ঘটনায় যেসব গাড়ি ছিল তাদের শতকরা, মোটর সাইকেল ২২.২৯%, ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান ১৭.৭২%, বাস/মিনিবাস ১৩.৮২%, অটোরিকশা, ৬.৩৪%, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ৫.৩০%, পিকআপ ৪.৭২%, ভ্যান ২.৯৩%, মাইক্রোবাস ২.৮৮%, ইজিবাইক ২.৭৭%, মোটর কার/জিপ ২.৬৩%, অ্যাম্বুলেন্স ২.০৫%, ট্রাক্টর ১.৬৩% ও অন্যান্য ১৪.৯০% দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সব দুর্ঘটনায় আহত প্রায় ৭,৪৯৫ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৫,৪৯৫টি।
২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত দুর্ঘটনার প্রতিবেদন :
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ এর পোর্টালে মাসিক প্রতিবেদন প্রচার হচ্ছে তাতে দেখা যায়, গত ৩ মাসের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে জানুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪৩৭টি, নিহতের সংখ্যা ৪০৪ জন, আহতের সংখ্যা ৫১৪ জন। ফেব্রম্নয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫৬৯টি, নিহতের সংখ্যা ৫২৩ জন, আহতের সংখ্যা ৭২২ জন। মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬২৪টি, নিহতের সংখ্যা ৫৫০ জন, আহতের সংখ্যা ৬৮৪ জন। এতে দেখা যায়, গত তিন মাসেই সর্বমোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৬৩০টি, তাতে নিহতের সংখ্যা ১,৪৭৭ জন ও আহতদের সংখ্যা ১৯২০ জন। তবে এখানে এপ্রিলের তথ্য যুক্ত হয়নি। এই এপ্রিল মাসে ঈদ ও বৈশাখী ছুটিতে অনেক যাত্রী গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত করেছে। তাতে দুর্ঘটনায় অনেকে নিহত ও আহতদের সংখ্যাও রয়েছে।
উপরোক্ত এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দেখা যায় :
ক. ত্রম্নটিযুক্ত গাড়ি, খ. অনভিজ্ঞ বা নেশাখোর ড্রাইভার, গ. ধারণ ক্ষমতার অধিক মাল বা যাত্রী বহন, ঘ. ওভারটেকিং বা চালকদের দায়িত্বহীনতা, ঙ. ট্রাফিক আইন না মানার মানসিকতা, চ. বিশ্রাম ছাড়া ১২-২০ ঘণ্টা গাড়ি ড্রাইভিং, ছ. গতি সীমা না মানা, ঝ. পরিবহণ মালিকদের উদাসীনতা ও সতর্কতা অবলম্বন না করা ইত্যাদি।
এছাড়াও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, রেল ক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন ওঠে আসাসহ আরও কয়েকটি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এভাবে প্রতিদিন ক্যান্সারের ন্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
এই সমস্যা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আরও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যেমন : রাস্তা সংস্কার, ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়ন, পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যানবাহন বিধি ও আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং মিডিয়াগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারের ব্যবস্থা করা।
সড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি :
আরও একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারাদেশের সড়কে এখন ছয় লাখের বেশি যানবাহন চলছে অবৈধভাবে, যাদের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই।
সড়কে অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো ও শ্রমিকদের মাদক গ্রহণ বন্ধ করা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করা, সড়কের ত্রম্নটি দূর করা, অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা- এসব নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে দুর্ঘটনা কমেনি।
সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের উদ্যোগ ও প্রতিশ্রম্নতির কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি :
সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে ২০০৮ সাল থেকে তিন বছরমেয়াদি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে আসছে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ২০০৮-২০১০, ২০১১-২০১৩, ২০১৪-২০১৬ ও ২০১৭-২০২০ কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কী সফলতা, তা মূল্যায়ন করেনি সরকার। ফলে এসব কর্মপরিকল্পনা কাগজেই রয়ে গেছে।
সড়ক নিরাপদ করতে সর্বশেষ কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগের নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ, বিআরটিএ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি।
সরকার অবশ্য নানা কাজ করছে। যেমন দূরপালস্নার চালকদের ক্লান্তি দূর করতে মহাসড়কের পাশে কিছু বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। এরপর সওজ কুমিলস্না, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ এবং মাগুরায় পণ্যবাহী গাড়িচালকদের জন্য চারটি আধুনিক সুবিধাসংবলিত বিশ্রামাগার স্থাপনের প্রকল্প নেয়। এখনো সেগুলো চালু হয়নি। এ ছাড়া সারাদেশে ১৭২টি স্থানে (বস্ন্যাক স্পট) সড়কের বাঁক সোজা করা হয়েছে, কিন্তু দুর্ঘটনা কমছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক এক বক্তব্যে বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার এবং বেশি সংখ্যায় প্রাণহানির মতো অবস্থা সড়কে বিদ্যমান। দুর্ঘটনা কমানো ও প্রাণহানি ঠেকাতে সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং সে অনুযায়ী কোনো কর্মসূচি নেই। এমনি এমনি প্রাণহানি কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
নিরাপদ সড়কের জন্য পাঁচ বছর আগে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারে দিক থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা এখন ভিন্ন। দেশের সড়ক-মহাসড়ক দিন দিন আরও প্রাণঘাতি হয়েছে। সরকারি হিসাবই বলছে, বিদায়ী বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের মৃতু্য হয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্যোগ :
পপুলেশন রেফারেন্স বু্যরোসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর এ ধারা ২০২০ সালে নাগাদে সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মৃতু্যর কারণ হিসেবে জাতিসংঘের তৃতীয় স্থান দখল করেছে। জাতিসংঘের সংস্থার তথ্য মতে এ সংখ্যা ২০৩০ সালে নাগাদ সপ্তম স্থানে আসবে মনে করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মধ্যে বেশিরভাগ ১৫-২৯ বছর বয়সি মানুষের সংখ্যা বেশি।
জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কিন্তু এখনো কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ।
দুর্ঘটনায় হতাহতের বড় অংশই কর্মক্ষম ব্যক্তি। এর প্রভাব ভুক্তভোগীর পরিবার ছাড়াও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের নীতিনির্ধারকদের বদ্ধমূল ধারণা যে, রাস্তা বড় আর মসৃণ করলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে, এটা ভুল। সড়কে নৈরাজ্য রেখে রাস্তা বানালে কোনো লাভ হবে না।
আশা করি, উপযুক্ত কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে ঠিকই তবে সেটা বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই সরকার যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় রুপকল্প-২০৪১ অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক সেভাবেই সরকারকে 'সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্প' গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই রোধকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত সব প্রতিষ্ঠান ও চালককে সঠিক গাইড লাইন অনুসরণে বাধ্য করতে হবে। তাহলে অচিরেই দ্রম্নত এই দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।
সাব্বির হোসেন রানা : নবীন কলাম লেখক