ফিলিস্তিন এখন এক রক্তাক্ত জনপদ। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, ফিলিস্তিনিরা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ইসরাইলিদের নিষ্ঠুর নির্মম ও বর্বর হামলায় শিশুসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়েছে।
আল আকসা মসজিদের অবস্থানরত জেরুজালেমের পূর্ব অংশের দাবিদার কেবল ফিলিস্তিন। অথচ এই শহরকে পুরোপুরি নিজেদের করায়ত্তে করেছে ইহুদিরা। এ নিয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে চলছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সহিংসতা। ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইলরা পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি গড়তে শুরু করে। ১৯৮০ সালে জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে ইসরাইল। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তখন তাদের সমর্থন দেয়নি। পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে প্রথম গণঅভু্যত্থান বা ইন্তিফাদার সূচনা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৩ সালে দু'দেশের মধ্যে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে। ওই শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিনও চায় পূর্ণ জেরুজালেম তাদের রাজধানী হবে। কিন্তু সংকটের সমাধান হয়নি।
বিশ্ববাসী জানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এই অপকর্মের প্রত্যক্ষ সহযোগী ও ইন্ধনদাতা। এই বিদেশি অপশক্তি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সময়েও তাদের অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা করেছে। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের কলঙ্কজনক কালো অধ্যায়ের রূপকার হিসেবে কলকাঠি নেড়েছিল তারা। বলতে লজ্জা লাগে এরা (আমেরিকা) এখন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য গলাবাজি করে। এমনকি তৃতীয় বিশ্বের অনেক স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ করে থাকে। এদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে জনমত সৃষ্টি হলেও পরাশক্তির ভয়ে আমাদের দেশের ইসলামপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো রহস্যজনক নীরবতা পালন করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য বিশ্বনেতাদের তাগিদ দিয়ে মানবাধিকারের প্রতি প্রাণভরা সমর্থন ও দরদ প্রকাশ করেছেন।
ফিলিস্তিন ভূমিতে দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে মার্কিনি ও পশ্চিমা দেশের মদতে যে বর্বরোচিত হামলা, বোমা বর্ষণ চালিয়ে বারবার গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এটা মুসলিম বিশ্বের ব্যর্থতা। তবে বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামে পাশে ছিল এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন যুগিয়ে আসছে।
আমেরিকা জোর গলায় মানবাধিকারের কথা বলে, অথচ তাদের ইন্ধন ও প্রশ্রয়ে সারাবিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এটা কথিত সভ্য দেশগুলোর ললাটে কলঙ্কের চিহ্ন হয়ে আছে। এই চিহ্ন মুছতে হলে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে গাজায় ধারাবাহিকভাবে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এই হামলার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিয়ে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ আবাসভূমি দখল করে নেওয়া। এই ইসরাইলকে আবার মদত দেওয়ার উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইল সফরে গিয়ে পূর্বের সব ইতিহাসের মধ্যে নিকৃষ্টতম উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মদতের কারণে ইসরাইল হামলা থামাচ্ছে না, যুদ্ধবিরতিও মানছে না। আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনের আবাসভূমি ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাই এবং চলমান হামলা ও গণহত্যা বন্ধ করতে জাতিসংঘের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করার দাবি জানাই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমরা সারা বিশ্বে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরাও অবিলম্বে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলা বন্ধের দাবির পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই আজ অবস্থান নিয়েছি। আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি সংহতি জানাই। পৃথিবীর মানুষের মতো ফিলিস্তিনিদেরও অধিকার আছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার। কিন্তু দখলদার ইসরাইল বর্বরোচিত হামলার মধ্য দিয়ে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করার তৎপরতা চালাচ্ছে। রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। আমরা ইসরাইলি বাহিনীর এ বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানাই।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত গাজায় গণহত্যা বন্ধ এবং একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা। ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তোনিও তাজানি উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এড়াতে আমরা সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এড়াতে উভয়পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা বিশ্বনেতাদের অভিমতের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করি এবং আশা করতে চাই, বিশ্বশান্তি শুধু নয়, নিজেদের স্বার্থেই দুই পক্ষ সংযম দেখাবে। শান্তির জন্য তার বিকল্প নেই।
শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল' ইয়ার্স ফোরাম