নিজেদের বাঁচাতে ধরিত্রী রক্ষা করতে হবে

ধরা বা ধরিত্রীকে যত্ন নিতে এবং টিকিয়ে রাখতে আমাদের করণীয় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সব মানুষকে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে হবে। বৃক্ষ কর্তনরোধ, বৃক্ষরোপণ ও বনসৃজনের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বনাঞ্চল, জলাশয়, নদনদী, খাল-বিল সংরক্ষণ করতে হবে। নদী সাগরে পস্নাস্টিক ফেলা বন্ধ সহ পস্নাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।

প্রকাশ | ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

শফিকুল ইসলাম খোকন
মানুষের প্রাণ না থাকলে যেমন জীবন্ত মানুষ বলা যায় না, তেমনি পৃথিবী না থাকলে মানুষের জীবন অস্তিত্বহীন; অর্থাৎ পৃথিবী না থাকলে মানুষেরও বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। আমি যদি ভুল না বলে থাকি, বর্তমানে যেভাবে পরিবেশ হুমকি মুখে পড়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আজ পৃথিবী যে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তাতে জীবন দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে। মানুষ, প্রাণিকুল বাঁচাতে যেমন পৃথিবীর দরকার, তেমনি আমাদের জন্যই পৃথিবীকে রক্ষা করা দরকার। পৃথিবীকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে, পৃথিবী এখন স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে যেতে বসেছে। যদি বলি পৃথিবী আজ স্বাভাবিক নয়; পৃথিবীর স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে বা ফেলেছে? হয়তো আমার কথায় অনেকেই হাস্যকর হিসেবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো? পৃথিবী আজ কোন পথে হাঁটছে, পৃথিবী কি আগের মতো আছে কিনা, পৃথিবীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুনিয়ার বিবর্তন কি? এমন প্রশ্নের উত্তর রয়েছে অনেকের কাছেই। কিন্তু কেউ বলবে, কেউ বলতে পারছে অথবা কেউ বলবেই না। কেউ বলুক আর নাই বা বলুক পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকটের জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, দায়ী আমরা। আর তাই পৃথিবী রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। ধরিত্রী শব্দটি এসেছে ধরণী বা ধরা থেকে। যার অর্থ হলো পৃথিবী। এর অপর নাম 'পৃথ্বী'। পৃথ্বী ছিল পৌরাণিক 'পৃথুর' রাজত্ব। এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে- বসুধা, বসুন্ধরা, ধরা, ধরণি, ধরিত্রী, ধরাতল, ভূমি, ক্ষিতি, মহী, দুনিয়া ইত্যাদি। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বসম্মত ধার্য করা একটি দিবসই হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সানফ্রান্সিসকোতে ইউনেসকো সম্মেলনে শান্তিকর্মী জন ম্যাককনেল পৃথিবীকে মায়ের সম্মানে ভূষিত করার যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে পৃথিবীর জন্য একটা দিনকে উৎসর্গ করার প্রস্তাব করলেন। তার সেই প্রস্তাব পাস হওয়ার পর ২১ মার্চ, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এই দিনটা উদ্‌?যাপিত হয় উত্তর গোলার্ধে। এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগই নেই যে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় পুড়ছে পৃথিবী, চরম সংকটে মানব সভ্যতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর আগ্রাসী রূপ দেখছে পৃথিবী। শুধু শীতপ্রধান ইউরোপ কিংবা বৈচিত্র্যপূর্ণ এশিয়াই নয়, বৈশ্বিক উষ্ণতায় পুড়ছে পুরো পৃথিবী। তীব্র হচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা। দ্রম্নত বাড়ছে সাগরের উচ্চতা। কমে যাচ্ছে শীতের সময়কাল। দীর্ঘ হচ্ছে গ্রীষ্ম। তীব্রতর হচ্ছে গরম। সারা পৃথিবীতে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। বাংলাদেশও অনুভব করছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই বিভীষিকা। উলট-পালট আচরণ করছে দীর্ঘদিনের পরিচিত আবহাওয়া। ফলে রেকর্ড উষ্ণ দিন পার করেছে বঙ্গোপসাগরের এই ব-দ্বীপ দেশটি। এপ্রিল থেকে জুলাই টানা চার মাস তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। প্রায় পুরো বর্ষা বৃষ্টিহীন থেকে শ্রাবণের শেষে এসে বৃষ্টি ঝরছে। ফলে বর্ষার প্রধান ফসল আমন আবাদ পিছিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ভাঙছে তাপমাত্রাবিষয়ক বিভিন্ন রেকর্ড। দেশে দেশে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে অস্বস্তিতে পড়েছে মানুষ। দেখা যাচ্ছে দাবানল। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের সবুজ বেলাভূমি নিধন, লবণাক্ততা, নদী দখল, নদীতে বর্জ্য ফেলাসহ নানা ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে একের পর এক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সামুদ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফের স্তর যে রেকর্ড গতিতে ভাঙছে তাতে রীতিমতো শংকিত বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, যে রকম দ্রম্নত গতিতে এবং যে সময়ের মধ্যে এসব রেকর্ড ভাঙছে তা 'নজিরবিহীন'। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী জুড়ে আবহাওয়ায় যে নানা অস্বাভাবিক প্রবণতা দেখা দিচ্ছে এবং অস্বাভাবিক গরম বা ঠান্ডা, বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, দাবানল ইত্যাদি এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘ বলছে, ইউরোপজুড়ে যে তাপপ্রবাহ চলছে তা আরও রেকর্ড ভাঙার দিকে এগোচ্ছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাকৃতিক ইভেন্ট এল নিনোর কারণেই এমনটা হচ্ছে। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের জলবায়ু বিজ্ঞানের লেকচারার ডক্টর পল সেপ্পি বলছেন, 'পৃথিবী এখন লাগামহীন পরিবর্তনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে- যার পেছনে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ঘটা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে 'এল নিনো'র প্রভাবে পৃথিবী গরম হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।' ২০২৩ সালে বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, আল-জাজিরা, দা গার্ডিয়ান প্রভৃতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফলাও করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, তার কারণ প্রতিকার নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসব গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের এপ্রিল থেকে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ দফায় দফায় রেকর্ডভাঙা তাপপ্রবাহের মুখে পড়ে। বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত দেশগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। প্রচন্ড গরমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন ও জাপান পর্যন্ত উত্তর গোলার্ধের অনেক দেশে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই তাপপ্রবাহকে 'নজিরবিহীন' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ, বিশেষ করে বাংলাদেশে গরমের কথা পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে তুলে ধরা বাহুল্যই বটে। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে সিএনএনের প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছিল, ভারত ও বাংলাদেশে যে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে 'হয়তো মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা অন্তত ৩০ গুণ বেড়ে এমনটি হয়েছে।' অর্থাৎ, কল-কারখানার ধোঁয়া, বনাঞ্চল উজাড়সহ মানবসৃষ্ট দূষণ না হলে এমনটি হতো না। পাঠকদের কাছে প্রশ্ন একটু ভেবে দেখুন তো উপকূলীয় অঞ্চলে আপনাদের বাড়ির চারপাশে নদী, খাল, জলাশয় ছিল তাকি এখন বিদ্যমান আছে? আগে যেমন চারপাশে গাছগাছালি ছিল এখন তা আগের মতোই আছে? আগে যেমন গরমের দিনে বাতাস ঠান্ডা ছিল এখন কি আছে- না গরমের দিনে গরম বাতাসই আছে। আগের মতো কি পানি পাওয়া যায়, আর পানি পেলেও কি সুপেয় পানি আছে, না লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। আগের চেয়ে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস কি বেড়েছে না কমেছে। আপনার বাড়ির মধ্যে জলাশয়, খালগুলো কি ভরাট করেছেন? আগের মতো প্রাকৃতিক বাগান এবং জীববৈচিত্র্য কি আছে। এ রকমের কত শত প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এর উত্তর কি আসবে। হঁ্যা, একেক জনের মনে একেক রকমের জবাব আসবে। আমার কাছে এক কথায় জবাব রয়েছে- আর তা হলো বর্তমানে প্রকৃতির দৃশ্যমান যে অবস্থা তা ভালো নেই। আগের মতো পানি নেই, জলাশয় নেই, বাগান নেই, জীববৈচিত্র্য বা প্রাণিকুল নেই, নদী ও খালের গতি নেই, বন নেই, যা নেই তা আমাদের কারণেই নেই। পৃথিবী যেমন স্বাভাবিক গতি নেই, তেমনি মানুষের জীবনযাপনও স্বাভাবিক নেই। তাহলে কি করতে হবে, আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, রক্ষা করতে হবে। আমাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশের উপকূলবাসীদের প্রতিনিয়তই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। উপকূলীয় মানুষজন এখন নতুন এক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় দেশের বাকি মানুষের করণীয় কী? তারা কি হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকবেন? নাকি সবাইকে নিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করবেন? বিষয়টি যেহেতু বৈশ্বিক, তাই দায়িত্ব বিশ্ববাসীর, এ মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ধনী-দরিদ্র প্রতিটি দেশকেই সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ খুঁজে বের করা চাই। তারপর প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে অসুস্থ পৃথিবীকে। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যেককে থাকতে হবে কার্যকর ভূমিকায়। ধরা বা ধরিত্রীকে যত্ন নিতে এবং টিকিয়ে রাখতে আমাদের করণীয় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সব মানুষকে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে হবে। বৃক্ষ কর্তনরোধ, বৃক্ষরোপণ ও বনসৃজনের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বনাঞ্চল, জলাশয়, নদনদী, খাল-বিল সংরক্ষণ করতে হবে। নদী সাগরে পস্নাস্টিক ফেলা বন্ধ সহ পস্নাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দিকে সব মানবজাতিকে নজর দিতে হবে। রি-সাইকেল পদ্ধতির মাধ্যমে দ্রব্যের পুনর্ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য মাঠপর্যায় সচেতনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপহার হিসেবে কাছের মানুষকে এক হাতে বৃক্ষ আরেক হাতে বই দিতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বাধ্যতামূলক পাঠ দানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একটি নিরাপদ, টেকসই ও সুন্দর ধরিত্রীর জন্য আসুন, নিজেদের জন্যই নিজেরা ধরিত্রী রক্ষায় এগিয়ে আসি। \হ শফিকুল ইসলাম খোকন : কলাম লেখক