ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের তিনদিক দিয়ে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সর্বদিক থেকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে তারা। অস্ত্র, সৈন্য, যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরাসহ প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছিল দেশটি। তখন তাদের জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থা এখনকার মতো ছিল ভালো ছিল না। তবুও বাংলাদেশ তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময় পাশে পেয়েছে বন্ধু দেশ ভারতকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বলা হয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় দিপক্ষীয় সম্পর্ক সবচেয়ে উচ্চ স্থানে অবস্থান করছে বর্তমানে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্লেষকের ধারণা, আওয়ামী লীগ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অন্য সময়ের তুলনায় বেশি ভালো থাকে। এটা বিভিন্ন কারণেই হয়। তবে বাংলাদেশ ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে আছে সীমান্ত হত্যা নামক একটি গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ৪,০৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৬ মাইল) দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। এই সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সীমান্ত হত্যা এক ত্রাসের নাম হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে বহু দিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান হয়েছে। ছিটমহল বিনিময়, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি, যার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সীমান্ত হত্যা চলছেই।
আয়তনে ভারত অনেক বড় দেশ। ভারতের উত্তর সীমান্তের রাষ্ট্রগুলো হলো চীন, ভুটান ও নেপাল। পশ্চিমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত এবং পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অবস্থিত। পাকিস্তান এবং চীন সীমান্তে ভারতের ঝুঁকি সবসময় বেশি। বিশেষত কাশ্মীর এবং লাদাখে প্রায়ই সহিংসতার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখি? এসব এলাকা নিয়ে ভারতের নিরাপত্তা সমস্যা সবচেয়ে বেশি। নেপাল ও ভুটান সীমান্তেও তাদের সমস্যা খুব একটা কম নয়? ভারত যে সীমান্ত নিয়ে সবচেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত থাকে, তা হলো বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত। কারণ, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিরোধী কোনো কাজ এই সীমান্তে হয় না? অথচ তাদের দেশের সেনাবাহিনীর হাতে সবচেয়ে বেশি নিহত হয় এই সীমান্তে থাকা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। কথায় আছে, একজন খারাপ প্রতিবেশী হলো অভিশাপ, যেমনটা একজন ভালো প্রতিবেশী হয় আশীর্বাদস্বরূপ। বাংলাদেশও তেমনি প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, গত ১৫ বছরে এই সীমান্তে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিরোধী কোনো কার্যক্রম হয়নি? এমন অবস্থায় যেখানে তাদের সেনাবাহিনীর নমনীয় থাকা উচিত, সেখানে তারা পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হত্যা করে। এমনকি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্য নিহত হওয়ার নজিরও আছে। এই আচরণ তো সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে হতে পারে না। সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান দেখলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ২০০-এর বেশি বাংলাদেশি। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে গত বছর ২৮ জনের প্রাণহানি ও ৩১ জন মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসকের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ। ওই বছর ৪৮ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারান, যার মধ্যে ৪২ জন বিএসএফের গুলিতে ও ছয়জন শারীরিক নির্যাতনে মারা যান। এর আগের বছর যে ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৩৭ জন বিএসএফের গুলিতে এবং ছয়জনের মৃতু্য হয়েছে নির্যাতনে। গত সাত বছরের মধ্যে বিএসএফের গুলিতে সবচে কম বাংলাদেশির মৃতু্য হয় ২০১৮ সালে ১৪ জনের।
সরকারি হিসাব মতে, ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫ এবং ২০১৭ সালে ১৭ জন।
এ বছরের ২১ জানুয়ারি বিএসএফ'র গুলিতে একজন বিজিবি সদস্য নিহত হয়।
সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে বিএসএফের গুলিতে ফেলানী হত্যার পর বাংলাদেশের দাবির মুখে দিলিস্নতে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা পূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সমঝোতায় আসে। সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। কিন্তু তবুও হত্যাকান্ড থামছে না। গত মাসে ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সীমান্তে হত্যা, আহত ও মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে যৌথ টহল জোরদারে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছিল। বাংলাদেশ বর্ডারে অস্ত্র-সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করার কথাও বলা হয়েছিল। অথচ সেই সম্মেলনের পরও পুরোদমে সীমান্তে হত্যাকান্ড চলমান রয়েছে।
ভারতের অন্য কোনো সীমান্তে তাদের সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের হত্যার এমন নজির নেই।
সীমান্তে মাদক এবং গরু চোরাকারবারিদের তৎপরতা আছে। কিন্তু তাই বলে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলতে হবে? যারা অপরাধী, তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে, কিন্তু হত্যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে যে কোনো ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এই বিষয়গুলো দেশের আপামর মানুষকে নাড়া দেয়। হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মানুষ এগুলো স্বাভাবিকভাবে নেয় না। সাধারণ মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করা হয়। সীমান্ত হত্যা বন্ধে বর্তমান সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে আসছে। কিছুদিন পূর্বে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরেও এই বিষয় ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি। সরকার খুব গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়টি দেখছে এবং চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই ভালো ব্যাপার, কিন্তু যে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, যাদের সন্তান পিতৃহারা হচ্ছে, তার দায় কে নিবে? ফেলানী হত্যা নাড়া দিয়েছিল দেশের মানুষকে, কিন্তু সেই বিচারও হয়নি এখনো। সরকারের উচিত, এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের পরামর্শ নেওয়া এবং সীমান্ত হত্যা রোধে গুরুতর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।