শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শ্বাপদসংকুল পথ মাড়িয়ে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে

অনেকের মতে, বিএনপিতে 'মাইম্যান' তৈরির মেশিনারিজ যতটা শক্তিশালী, ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা তৈরির মেশিনারিজ ততটাই দুর্বল। বিএনপির পক্ষে ঘরের সংকট/সমস্যা এবং প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানো সত্যিকার অর্থেই শক্ত চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শ্বাপদসংকুল পথ মাড়িয়েই বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
জহির চৌধুরী
  ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শ্বাপদসংকুল পথ মাড়িয়ে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে

মনে হচ্ছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে বারবার হোঁচট বিএনপি'কে ভাবাচ্ছে, নতুন কৌশল, পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের কয়েকটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিএনপি'তে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে; নতুন করে দল ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিষ্ক্রিয়দের বাদ দিয়ে আন্দোলনে রাজপথে থাকা সক্রিয় নেতাদের সমন্বয়ে নতুন নেতৃত্বে সংগঠন (বিএনপি) সাজানো হবে; কর্মকান্ড মূল্যায়ন করে বিভিন্ন শূন্যপদ পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে; আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করা হবে; অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে; আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ভুলত্রম্নটি বের; পরিকল্পনা করে কর্মপন্থা নির্ধারণ; বুদ্ধিভিত্তিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা হবে; ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগের আন্দোলনের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে হাঁটবে বিএনপি, দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময়ের ১৯ দফার আলোকে গড়া বিএনপির মতো না হলেও ১৯৯১ সালের বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির মতো করে গড়ে তোলা হবে।

\হস্বীকার করতে হবে, বিগত দিনের আন্দোলনে বিএনপির ব্যর্থতা রয়েছে। আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত না হলে সে আন্দোলন কার্যত পন্ডশ্রম। বিএনপির বিগত দিনের আন্দোলন মূল্যায়ন করে যদি বলা হয় বিগত দিনের আন্দোলন বহুলাংশেই পন্ডশ্রম হয়েছে তাহলে ভুল হবে না। সত্যান্বেষী হতে হবে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠার জন্যই। নিরাশ হলে বা আশা নেই মনে করলে রাজনীতিতে টিকে থাকা, দল টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। নিরাশার মধ্যেই আশা লুকিয়ে থাকে। বিএনপি বিগত দিনে আন্দোলনে কামিয়াব হয়নি বলে অনাগত দিনেও কামিয়াব হবে না- এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। বিএনপি বিপুল জনসমর্থিত দল। বিপুল জনসমর্থিত দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। প্রতিপক্ষ বিএনপিকে যতই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করুক না কেন; তারাও জানে বিএনপি'র ঘুরে দাঁড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অতীতের আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণসমূহ বাস্তবানুগ হয়ে খতিয়ে দেখে ভুলত্রম্নটি শোধরিয়ে এগুতে পারলে ভবিষ্যতে বিএনপি সাফল্য পেলেও পেতে পারে। বিএনপি যদি আদতেই উপলব্ধি করে থাকে বিগত দিনে দল পরিচালনায়, আন্দোলনে ভুল-ভ্রান্তি, ত্রম্নটি-বিচু্যতি ছিল- তাহলে ব্যর্থতা মোচনের করণীয় খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। সমস্যা নির্ণয়ের সক্ষমতা বিজ্ঞতার পরিচায়ক। চিকিৎসা শাস্ত্রে বলে, চিকিৎসক সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারলেই রোগের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া এবং রোগীকে রোগমুক্ত করা সম্ভব হয়। তেমনি সঠিক বা নির্ভুলভাবে ভুলত্রম্নটি, ত্রম্নটি-বিচু্যতি নির্ণয় করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে।

ভবিষ্যতে আন্দোলনে বিএনপি সফল হবে কি হবে না তা সময়েই বলে দেবে। বিএনপি রিফর্ম বা পুনর্গঠন, বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানো সংক্রান্ত সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কি ধরনের ব্যবস্থা নেবে বা নিতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা বা ঈঙ্গিত পাওয়া যায়। বিএনপিকে টিকে থাকার প্রয়োজনেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে; এ ছাড়া উপায় নেই। বিএনপি যদি দলে অবদান মূল্যায়ন করে পদায়ন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, অতীতের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান, আত্মসমালোচনা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার, বুদ্ধিভিত্তিক সংগঠন পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার প্রয়েজনীয়তা অনুভব করে থাকে তাহলে ধরে নেওয়া যায়- দেরিতে হলেও চৈতন্যেদয় ঘটছে। বিএনপিতে ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাকর্মী অবমূল্যায়ন, নব্য/ অনুপ্রবেশকারী/চাটুকার/তোষামদ-তোয়াজকারীদের 'অতি মূল্যায়ন'-এর ঘটনা বহু রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলে অবদান রেখেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করেছেন এমনদের অনেকেই দলে অবমূল্যায়িত, অপদস্থ হওয়ার নজির আছে। যে কোনো, দলের প্রাণ দলবান্ধব/দল দরদি/দল নিবেদিত নেতাকর্মী। নেতাকর্মীদের উপেক্ষা-অবমূল্যায়ন করা; সুযোগ সন্ধানী, তেলবাজ, তোয়াজ-তোষামদকারীদের, 'লিডার সব ঠিক আছে আমরা আছি কোনো চিন্তা করবেন না লিডার' বলে নেতাকে খুশি করে যারা তাদের 'খাতির দেখানো' প্রকারান্তরে দল নিধন কর্মকান্ডই। চরম প্রতিকূল অবস্থায় নিপতিত বিএনপি। এ অবস্থায়ও বিএনপিতে পরীক্ষিত/ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন, কোণঠাসা করে রাখা, পদ/মনোনয়ন বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ শোনা যায়। দলের চেয়ারম্যান/ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুমোদন দেওয়া কমিটিতে থাকা নাম কেটে পছন্দের ব্যক্তির নাম ঢুকানোর, চেয়ারম্যান/ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত অমান্যের নজির আছে বিএনপিতে। দলের চেয়ারপার্সন অনুমোদিত কমিটি থেকে নাম কেটে পছন্দের ব্যক্তির নাম কীভাবে ঢুকানো হয়, দলীয় প্রধানকে কীভাবে ভুল পরামর্শ দেওয়া হয়, বিভ্রান্ত করা হয়- সে সম্পর্কে পিলে চমকানো কিছু তথ্য বিএনপি ঘরানার সাংবাদিকখ্যাত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের খোঁজ-খবর যারা রাখেন তারা বিএনপির হাঁড়ির সব খবর না জানলেও কিছু অন্তত জানেন। আমার জানামতে, একটি জেলার সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমন একব্যক্তিকে যিনি নব্য বিএনপি। এ জেলায় বিএনপি গঠিত হয়েছে দলটির আত্মপ্রকাশের পরপরই। প্রায় ৫ দশক বয়সি এ জেলা দলে সমন্বয়ক করার মতো কেউকে খুঁজে পায়নি বিএনপি। জেলা বিএনপি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের বা দীর্ঘদিন স্থানীয় ছাত্রদল করে জেলা দলে এসেছেন এমনদের মধ্যে সমন্বয়ক হওয়ার যোগ্য কেউই কি ছিলেন না? যদি ধরে নেই- ছিলেন না। তাহলে, বলতে হবে জেলায় বিএনপি সাইনবোর্ড বা নাম সর্বস্ব হয়ে গেছে। এ জেলায় বিএনপির এতটা দেউলিয়া অবস্থা- মনে হয় না। শোনা যায়, এ জেলায় বিএনপির ত্যাগী/পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে অনেকটা নিষ্ক্রিয় আছেন। বিএনপিতে ত্যাগী/পরীক্ষিত নেতাকর্মী মূল্যায়ন আদতেই জরুরি হয়ে পড়েছে।

আত্মসমালোচনা ব্যক্তি/ সংগঠন সংশোধন/পরিশোধনের সহায়ক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মসমালোচনা সহ্য বা ইতিবাচকভাবে নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। আত্মসমালোচনাকে দলের প্রতি শত্রম্ন মনোভাবাপন্নতার বহিঃপ্রকাশ গণ্য করা হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ। আত্মসমালোচনা সহ্যের মানসিকতা গুণ। আত্মসমালোচনা সহ্য করলে, ভালো চোখে দেখলে, আত্মসমালোচনা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপি উপকৃতই হবে। বুদ্ধিভিত্তিক সংগঠন সক্রিয় করার চিন্তা করছে বিএনপি। রাজনীতি উৎকর্ষ বুদ্ধির খেলা। প্রকৃত রাজনৈতিক দল মাত্রই কোনো না কোনো দর্শন/মতবাদভিত্তিক। মতবাদ বা দর্শন বুঝার বিষয়, বুঝতে বুদ্ধি লাগে। দর্শন/মতবাদভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা দলের দর্শন/মতবাদ বোঝা, জ্ঞাত থাকা, লালন-ধারণ-চর্চা করা আবশ্যক। এতে দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ, দলের শক্তি-সামর্থবৃদ্ধি, প্রতিদ্বন্দ্বী/প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা সহজ হয়। বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন/মতবাদ জাতীয়তাবাদ। ইংরেজিতে 'ন্যাশনালইজম'। ন্যাশনালইজম বা জাতীয়তাবাদতন্ত্র দলের নেতাকর্মীরা নিজেরাই যদি না বুঝে তাহলে জনগণকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করাতে পারবে না। আমজনতাকে দলের আর্দশে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে দলের রাজনীতি টেকসই হবে না। দলের রাজনীতি টেকসই'র জন্যই বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতি চর্চা জরুরি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় বুদ্ধিজীবীরা নবগঠিত বিএনপিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন- যা বিএনপির রাজনীতিসমৃদ্ধ করছে। বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতির জন্য বুদ্ধির কদর দিতে হয়। ধান্ধাবাজ বুদ্ধিজীবীদের দাপট-দৌরাত্মের যুগ এখন। ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবী/ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবীদের আখড়া পরিচিত সংগঠনগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে বিএনপিকে।

\হ৩১ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক বিএনপির সংগঠনিক হালচাল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব ছেপেছে 'সাত গুরুত্বপূর্ণ মহানগর নেতৃত্ব সংকটে' শিরোনামে। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বিএনপির সাতটি গুরুত্বপূর্ণ মহানগর শাখা নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে। তেরটি মহানগরের মধ্যে খুলনা, বরিশাল, কুমিলস্না, গাজীপুর, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীতে আগের মতো ত্যাগী ও পরীক্ষিত বড় কোনো নেতা তৈরি করতে পারেনি দলটি।' 'নেতা'য় কিলবিল করা দল বিএনপিতে ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতার আকাল কেন দেখা দিয়েছে তা বিএনপির নীতি নির্ধারকরাই বলতে পারবেন। তবে নির্মোহ মূল্যায়নে ত্যাগী নেতাকর্মী তৈরি/সৃষ্টিতে বিএনপির অনাগ্রহ-উদাসীনতা বেরিয়ে আসে।

অনেকের মতে, বিএনপিতে 'মাইম্যান' তৈরির মেশিনারিজ যতটা শক্তিশালী, ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা তৈরির মেশিনারিজ ততটাই দুর্বল। বিএনপির পক্ষে ঘরের সংকট/সমস্যা এবং প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানো সত্যিকার অর্থেই শক্ত চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শ্বাপদসংকুল পথ মাড়িয়েই বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে