খাবারের অপচয় করতে নেই- খুবই সহজ সরল, সাদামাটা এই কথা সবাই জানে। তবে বাস্তবতা হলো নামিদামি বুফে রেস্তোরাঁর টেবিল থেকে শুরু করে সাধারণ পরিবারের ডাইনিং টেবিল- সব জায়গাতেই খাবার-দাবারের ব্যাপক অপচয় হয়। কেবল এই দিকটা খেয়াল না রাখার জন্য কতটা বাড়তি খরচ যে আপনার হচ্ছে, সে হিসাব হয়তো আপনি নিজেও রাখছেন না। খাবারের অপচয় কিন্তু কেবল অর্থের অপব্যয়ই নয়, বরং নষ্ট করা খাবার প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপরও ফেলে নেতিবাচক প্রভাব। বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের ৮ শতাংশের জন্য দায়ী কেবল খাবারের অপচয়। খাবারের অপচয় এড়াতে এবং খাবারের ব্যয় কমাতে মিতব্যয় ও সচেতনতার বিকল্প নেই।
সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচির (ইউএনইপি) ওয়েবসাইটে বিশ্বের 'খাবার অপচয়সূচক প্রতিবেদন-২০২৪' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে খাবারের এ অপচয়কে 'বৈশ্বিক ট্র্যাজেডি' হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে। বিশ্বে খাবারের অপচয় নিয়ে এটি জাতিসংঘের সংকলিত দ্বিতীয় প্রতিবেদন। এটি তৈরিতে জাতিসংঘকে সহযোগিতা করেছে অলাভজনক সংস্থা ডবিস্নউআরএপি। প্রতিবেদনটি এখন পর্যন্ত খাবার অপচয়ের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে। ডবিস্নউআরএপি বলছে, 'এটা আমাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। আসলে বছরের প্রতিদিন এক বেলায় যত খাবার নষ্ট হয়, তা দিয়ে বর্তমানে অনাহারে থাকা প্রায় ৮০ কোটি মানুষের সবাইকে খাওয়ানো সম্ভব।'
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে একজন ব্যক্তি গড়ে বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করেন- যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ভারতের চেয়ে বেশি। বিশ্বে ২০২২ সালে মোট অপচয় হওয়া খাবারের পরিমাণ ১০০ কোটি টনের বেশি- যা বিশ্ববাজারে আসা মোট খাবারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বাসাবাড়িতে এক ব্যক্তি বছরে গড়ে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় করে মালদ্বীপে, ২০৭ কেজি। বিপরীতে সবচেয়ে কম খাবার নষ্ট হয় মঙ্গোলিয়ায়, ১৮ কেজি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাসাবাড়িতে এক ব্যক্তি বছরে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় করে পাকিস্তানে, ১৩০ কেজি। এরপরেই আছে নেপালে, ৯৩ কেজি। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে মিয়ানমার (৭৮ কেজি), শ্রীলংকা (৭৬ কেজি) ও ভারত (৫৫ কেজি)। সবচেয়ে কম ১৯ কেজি খাবার অপচয় হচ্ছে ভুটানে। খাবার অপচয় সূচকের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তি বাসাবাড়িতে গড়ে বছরে খাবার অপচয় করছেন ৭৩ কেজি। যুক্তরাজ্যের তা ৭৬ কেজি। চীনের ক্ষেত্রেও হিসাবটা একই। তবে তুলনামূলক কম অপচয় হচ্ছে রাশিয়ায়, ৩৩ কেজি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে অপচয় হওয়া খাবারের ৬০ শতাংশই বাসাবাড়ির। এর পরিমাণ ৬৩ কোটি ১০ লাখ টন। ২৮ শতাংশ অপচয় হয়েছে রেস্তোরাঁ, ক্যানটিন ও হোটেলের মতো খাদ্য পরিষেবা ব্যবস্থাগুলোয়। কসাই ও মুদি দোকানে অপচয় হয়েছে ১২ শতাংশ খাবার। ওই বছরে অপচয় হওয়া ১০০ কোটি টনের বেশি খাবার ছিল বিশ্ববাজারে আসা খাদ্যদ্রব্যের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ যখন না খেয়ে আছে, তখন লাখো কোটি ডলারের খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে।
অন্যদিকে, জাতিসংঘের খাদ্য বর্জ্য কর্মসূচির (ফুড ওয়েস্ট প্রোগ্রাম) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে মোট খাদ্য অপচয়ের ৫০ শতাংশ হয় সৌদি আরবে- যা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং দেশটিতে খাদ্য বর্জ্যের জন্য প্রতি বছর ৪০ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল ক্ষতি হয়। এদিকে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলছে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়। ২০২৩ সালে সৌদি শস্য সংস্থার (সাগো) একটি গবেষণায় ওঠে এসেছে, খাদ্য অপচয়ের কারণে সৌদি যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ভোক্তা ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা হচ্ছে, এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল। এছাড়া সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ৪ দশমিক ০৬ মিলিয়ন টন খাদ্য নষ্ট হয়- যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ পণ্যের সমতুল্য। গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে প্রায় ১৮৪ কেজি খাদ্য অপচয় করেন।
বিভিন্ন পরিসংখানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার উৎপাদন হয়, তার একটি বড় অংশ মাঠ থেকে আর খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায় না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার 'ফুড ওয়েস্টেজ ফুটপ্রিন্ট : ইমপ্যাক্টস অন ন্যাচারাল রিসোর্সেস' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়- যা বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। খাদ্যের এ অপচয়ে উন্নত দেশ আর উন্নয়নশীল দেশ কেউই বাদ যায় না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা 'ইউনেপ'-২০২১ সালে 'ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স' নামে রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত আর পাকিস্তানের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয় হয় বাংলাদেশে। শুধু খাবার টেবিলের অপচয় রোধ হলেই ৪২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মিটত। আজ বিশ্বব্যাপী খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ছে, অথচ অপচয় কমছে না।
খাদ্য অপচয়কে ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। বিশ্বনবী রাসুলুলস্নাহ (সা.) খাবার অপচয় রোধে খুব শক্ত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। খাবার নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়ার কথা বলেছেন- যা সুন্নত। তিনি নিজেও দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার গ্রহণ করতেন- যাতে খাবার পাত্র থেকে পড়ে নষ্ট না হয়। কারণ খাবার হলো মহান আলস্নাহর নেয়ামত। এর অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) খাওয়ার পর তার তিনটি আঙুল চেটে নিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কারও খাবারের লোকমা নিচে পড়ে গেলে সে যেন তার ময়লা দূর করে তা খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, আমাদের তিনি থালাও চেটে খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, খাদ্যের কোন অংশে বরকত রয়েছে, তা তোমাদের জানা নেই (তিরমিজি ১৮০৩)। খাবার নষ্ট করা যেমন অন্যায়, তেমনি গুনাহর কাজ। এ প্রসঙ্গে মহান আলস্নাহ কোরআনে ইরশাদ করেছেন, (তোমরা) খাও, পান কর কিন্তু অপচয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না (সূরা আরাফ ৩১)। মহান আলস্নাহ আরও বলেছেন, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই (সূরা ইসরাইল ২৭)। খাওয়া-দাওয়া ও পানাহারের ক্ষেত্রে অপচয় ও বিলাসিতা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখোমুখি করে দেয়। তাই কোরআনে এটিকে কড়াভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আলস্নাহ বলেন, 'তখন তোমরা উহার ফল আহার করিবে আর ফসল তুলিবার দিনে উহার হক প্রদান করিবে এবং অপচয় করিবে না।' (সূরা আনআম ১৪১)।
রাসূল (সা.) বলেছেন, 'পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য ও এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য।' (ইবনে মাযাহ : ৩৩৪৯)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'দু'জনের খাবার তিনজনের জন্য এবং তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট।' মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেন, 'একজনের খাবার দু'জনের জন্য, দু'জনের খাবার চারজনের জন্য এবং চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।' (বুখারি-৫৩৯২, মুসলিম-২০৫৮, তিরমিজি-১৮২০)।
বাদশাহ হারুনুর রশিদ একবার চারজন ডাক্তারকে একত্র করলেন। তার মধ্যে একজন ছিল হিন্দুস্থানি, দ্বিতীয় জন রোমীয়, তৃতীয় জন ইরাকি, চতুর্থ জন সাওয়াদি। তারপর চারজনকেই সম্বোধন করে বললেন, আপনারা এমন একটি ওষুধের নাম বলুন, যা কোনো কিছুর জন্যই ক্ষতিকর নয়। হিন্দুস্থানি চিকিৎসক বললেন, আমার মতে সেই জিনিস হলো হালিলাহ সিয়াহ বা কাল হালিলাহ। ইরাকি ডাক্তার বললেন, আমার মতে সেই জিনিস হলো হুব্বুর রালাদ। রোমীয় ডাক্তার বললেন, ওষুধ কোনো কিছুর জন্য ক্ষতিকর নয়- তা হলো গরম পানি। সর্বশেষ সাওয়াদি ডাক্তার বললেন, উপরিউক্ত সব মন্তব্য ভুল। কেননা, কাল হালিলাহ পাকস্থলীতে ক্ষত সৃষ্টি করে। আর গরম পানি পাকস্থলীকে করে দেয় শিথিল। তারপর সব হাকিম মিলে বললেন, তাহলে এবার আপনি বলুন, যে ওষুধটা কোনো কিছুর জন্যই ক্ষতিকর নয়। তখন সাওয়াদি হাকিম বললেন, তা হলো অধিক আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আহার না করা ও খানার কিছু চাহিদা থাকা অবস্থায় খানা থেকে বিরত থাকা- এ কথার ওপর সব ডাক্তার একমত পোষণ করেন।
জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্যদ্রব্যের এক-তৃতীয়াংশ ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা হয়। এর ফলে, যে শুধু পরিবেশ দূষিত হয় তাই নয়, পকেটটাও অনেকটা ছোট হয়। তবে অপচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রয়োজন অনেক শক্তি ও শৃঙ্খলা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে একটি পরিবার বছরে গড়ে ৭০০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৮৩০ ইউরো পর্যন্ত নিক্ষেপ করে থাকে আবর্জনার কন্টেইনারে; অর্থাৎ ফেলে দেওয়া খাবারের অর্থমূল্য এই রকম হবে। শুধু ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় চেইন স্টোর টেস্কোর মাল সরবরাহকারী ও ভোক্তারা প্রতি বছর ৬০,০০০ টন খাদ্যের অপচয় করে। এই অবস্থার পরিবর্তন চায় এখন টেস্কো।
শুধু যে ব্রিটেনে ভোজ্যপণ্য আবর্জনার কন্টেইনারে পতিত হয় তাই নয়, এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা।
\হজাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, সর্বস্তরে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। বিশেষ করে মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যে খাদ্যদ্রব্যের অপচয় এক বিরাট সমস্যা। এর অর্থ আমাদের ভোক্তাদের কাছ থেকেই শুরু করতে হবে। পেস্নটে অল্প পরিমাণ খাবার নেওয়া উচিত। বেঁচে যাওয়া খাবার পরে খাওয়ার জন্য ঠিকমতো উঠিয়ে রাখতে হবে। কেনাকাটার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করা উচিত। অতিরিক্ত খাবার ফেলে না দিয়ে অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে- এসব পরামর্শ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। তবে এই ব্যাপারে শুধু ক্রেতাদের সচেতন ও মিতব্যয়ী হলেই চলবে না খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংস্থা যেমন সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেরও চোখ খুলতে হবে।
মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক